বড়নগর / চার বাংলা মন্দির / মুর্শিদাবাদের বারাণসী / রানী ভবানীর ইতিহাস
(Scroll down and read English Language)
বড়নগর, মুর্শিদাবাদ জেলার আজিমগঞ্জ শহর লাগোয়া একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান।
'আজিমগঞ্জ সিটি' রেল স্টেশন থেকে উত্তর দিকে মাত্র 1 কিলোমিটার দূরেই এই বরানগর। উত্তরবঙ্গ বা দক্ষিণবঙ্গ থেকে রেল ও সড়ক উভয় পথেই আসা খুব সহজ।
অষ্টাদশ শতকে মুর্শিদাবাদের বারাণসী বলা হতো এই বড়নগরকে। আগে বড়নগর রাজশাহী জমিদারীর অন্তর্গত ছিল এবং তখন এখানেই জমিদারীর সদর দপ্তর ছিল। রাজা উদয়নারায়ণের মৃত্যুর পর রাজশাহী জমিদারীর মালিক হয় নাটোর রাজবংশ। 1730 সালে রামজীবনের মৃত্যুর পর এই বিশাল জমিদারীর মালিকানা পান রামকান্ত ও তাঁর স্ত্রী রাণী ভবানী । রাজশাহী জেলার ছাতিম গ্রামের আত্মারাম চৌধুরীর কন্যা ছিলেন রাণী ভবানী। রামকান্ত ছিলেন সৎ, ধার্মিক এবং উদার মনের ব্যক্তি । তিনি বেশিরভাগ সময় পূজা পাঠে -ই ব্যায় করতেন তাই তার অভিজ্ঞ দেওয়ান দয়ারাম জমিদারীর সব কাজ পরিচালনা করতেন। 1748 সালে রামকান্ত মারা যান। রাণী ভবানীর বয়স তখন মাত্র 32 বছর ছিল তখন থেকেই জমিদারীর দায়-ভার গ্রহণ করেন তিনি। প্রজাদের অভাব অভিযোগ খুঁটিয়ে দেখে তার প্রতিকার করতেন ।জনসাধারণের জন্য তিনি যে সকল কাজ গুলি করেছিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জলের সমস্যার জন্য পুকুর খনন, ধর্মশালা নির্মাণ , শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ , রাস্তা নির্মাণ প্রভৃতি। বহু ধার্মিক হিন্দু ও মুসলিমদের নিষ্কর জমি দান করেছেন রাণী ভবানী।
বড়নগর, ভবানীপুর, বেনারস ও নাটোরে তৈরী করেছিলেন বছু দেবমন্দির। রানী ভবানীর লক্ষ্য ছিল তার রাজধানী কে প্রাচীন বারাণসীর মতো শহর হিসেবে গড়ে তোলার। 1753 থেকে 1760 -এর মধ্যে তিনি এই সকল মন্দির গুলি নির্মাণ করান। স্থানীয়দের মতে তিনি বড়নগরে শিবকে উৎসর্গ করে 108 টি মন্দির নির্মাণের ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন তিনি 107 টি নির্মাণ করতে পেরেছিলেন, আবার কেউ কেউ বলেছিলেন যে তিনি 108 টি মন্দির -ই স্থাপনা করান। যার মধ্যে অনেক মন্দির ভাগীরথীর গর্ভে তলিয়ে যায়। তিনি এই সব মন্দিরের পরিচালনার জন্য দান করেছে প্রচুর ভূ-সম্পত্তি। দান ও জনসেবার জন্য এই হিন্দু রানী ইতিহাসে চিরস্মর হয়ে আছেন।
এখানে নির্মিত মন্দির গুলির মধ্যে ভবানেশ্বরী মন্দির টি সব থেকে বড়। এটি একটি অষ্টকোনাকৃতি মন্দির। এর আটটি দরজা আছে এবং মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ লক্ষনীয়। এই মন্দিরে ভবানীশ্বর নামে এক শিবলিঙ্গ বিরাজমান।
রানী ভবানীর নির্মিত মন্দির গুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ হলো চার বাংলা মন্দির। মন্দিরটি চার দিকে চারটি বাংলো বিশিষ্ট হওয়ায় এরূপ নামকরণ।
কোনো কোনো জায়গায় এক বাংলা বা দুই বাংলা মন্দির লক্ষ্য করা গেলেও চার বাংলা মন্দির প্রায় অমিল তাই এর পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। এই মন্দির গুলির গায়ে টেরাকোটার কাজ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পূর্ব - পশ্চিম - উত্তর - দক্ষিণে চারটি মন্দিরের সমষ্টি এই চার বাংলা মন্দিরের প্রত্যেকটি তে 3 টি করে খিলান যুক্ত দরজা রয়েছে এবং প্রতিটি দরজার সামনে একটি করে শিবলিঙ্গ বিদ্যমান। অর্থাৎ চারটি মন্দিরে মোট 12 টি শিবলিঙ্গ রয়েছে। এই মন্দির গুলির গায়ে টেরাকোটার কাজের মাধ্যমে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহীনি ফুটে উঠেছে।
চার বাংলা মন্দির থেকে অনতি দূরেই আছে রাজ রাজেশ্বরী মন্দির। এই মন্দির বংশানুক্রমে ব্যক্তি মালিকানা সম্পত্তি, তবে বর্তমানে স্থানীয় বাসিন্দারা উত্তরাধিকারীর কাছে অনমতি নিয়ে একটি ট্রাস্ট গঠন করে দেখভাল করেন।
এর ভেতরে দেখা যায় রাজ রাজেশ্বরী দেবী, শ্রী শ্রী জয় দুর্গা দেবী ও করুনাময়ী দেবীর বিগ্রহ। এছাড়া প্রায় 300 বছরের পুরোনো অখণ্ড নিম কাঠে খোদাই করে বানানো মদনমোহন, মহালক্ষী ও রাধা দেবীর মূর্তি।
বড়নগরের আরো একটি উল্লেখযোগ্য মন্দির হলো জোড়বাংলা মন্দির বা গঙ্গেশ্বর শিবমন্দির। এই মন্দির টি বর্তমানে পুরাতত্ত্ব বিভাগের আওতায় নাম মাত্র দেখাশোনা করা হয়। এটি এক জোড়া মন্দিরের সমষ্টি বলে এর নাম জোড়া বাংলা মন্দির। এই মন্দিরের ভেতরেও তিনটি শিবলিঙ্গ দেখা যায়। এই মন্দিরের গায়েও টেরাকোটার কাজ মন কাড়ে।
এছাড়াও এই অঞ্চলে বিভিন্ন স্থানে বহু মন্দিরের ভগ্নাবশেষ জরাজীর্ণ অবস্থায় পরে থাকতে দেখা যায়, যেগুলি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আজ বিলুপ্ত প্রায়।
(লিখেছেন - বিমান চন্দ্র দাস। কোনো ভুল ত্রুটি হলে কমেন্টে জানাবেন, বিবেচনা করে দেখা হবে। নমস্কার 🙏)