কাঠগোলা বাগানবাড়ি
মুর্শিদাবাদ জেলার লালবাগে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র হলো এই কাঠগোলা বাগানবাড়ি।
রাস্তার পাশেই একটি বিশালাকার সিংহদ্বার।
সেই দ্বারের ভেতরে প্রবেশ করতেই দুই ধারে অগনিত গাছ আর তার মধ্যেই কিছু ঐতিহ্যবাহী স্তম্ভ আর কিছু অশ্বারোহী মূর্তি। মধ্যের সরু রাস্তা ধরে কয়েক পা এগোতেই দেখা যায় টিকিট কাউন্টার। সেখানে টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। মুখ্য বাড়িটি পৌঁছাবার আগেই বাম দিকে গুপ্ত সুড়ঙ্গ আর ডান দিকে চিড়িয়াখানা। এবার কাঠগোলা বাগান বাড়ির সামনে উপস্থিত হওয়া যাক।
বাড়িটির সামনেই একটা বিশাল পুকুর। পুকুরটির চারকোনে ও বাড়ির সামনে এবং তার বিবরীত পাড়ে সুন্দর ভাবে মোট ছয়টি ঘাট বাঁধানো। বাড়ির সামনের ঘাটটিতে একটি সুন্দর ফোয়ারা। সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতেই পুকুরে দেখা যায় রঙ - বেরঙের মাছ জলে খেলা করছে। এই মাছ গুলো খাওয়া হয় না। আর এগুলোর মধ্যে যদি কোনো মাছ মারা যায় তাহলে তাকে কবর দেওয়া হয়। নবাবী আমল থেকেই চলে আসছে এই রীতি। বাড়িতে প্রবেশ করতেই যদি কিছু চেনা চেনা লাগে তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই, এখানে অনেক সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে। এই ঐতিহাসিক বাড়িটির গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো হলো - কষ্টিপাথরের সিংহাসন, ১৮ ফুট উঁচু বেলজিয়াম আয়না, ৭৫ ফুট উঁচু বিনা স্তম্ভের কাঠের সিঁড়ি, মার্বেল টেবিল... ও হ্যাঁ এখানে যে মার্বেল টেবিল আছে তার সঙ্গে তাজমহলের মার্বেলের মিল পাওয়া যায়।
মুখ্য বাড়িটি থেকে বেড়িয়ে পূর্ব দিকে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলে দেখা যাবে ওখানে সামান্য উঁচু স্টেজের মতো হয়ে আছে ওটাকে জলসাঘর বা নাচমহল বলে। এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা নাচের আসর বসতো। ততকালীন নবাবী লোকেরা, ইংরেজ সাহেবরা ও ধনী ব্যাবসায়ী রা এখানে আসতেন । মনোরঞ্জনের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু নর্তকী কে নিয়ে আসা হতো এখানে। তখনকার ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় তাদের মধ্যে একজন ছিলেন হীরা বাঈ। সে নাকি প্রতি সন্ধ্যায় নাচ করার জন্য ৫০০০ মুদ্রা নিতো। তার একটি বিশাল ছবি হাজারদুয়ারী তে টাঙ্গানো আছে। নাচ মহল থেকে দুই ধারে গোলাপের বাগান ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলে সামনের দিকে একটু এগোতেই একটা ছোট স্তম্ভ লাগোয়া দুই ধারে দুটো মাছের মূর্তি দেখা যায়।
এখানেই মাছেদের কবর দেওয়া হয়।
তার কিছু দূরে চোখে পড়ে একটি মন্দির। এই মন্দিরের ভেতরে মোবাইল ব্যাবহারে নিষেধাজ্ঞা আছে। এই মন্দিরে প্রবেশ করার পূর্বে সবাই কে কথা বলতেও বারন করা হয়। তবে ধর্ম - বর্ণ নির্বিশেষে সকল পর্যটকদেরই এখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়।
নবাব দের বাগানবাড়ি তে মন্দির কিভাবে এলো এটি আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। বলে রাখি এটি নবাবদের তৈরী নয়। রাজস্থান থেকে আগত এক ব্যাবসায়ী এটি নির্মাণ করান। তিনি ছিলেন জৈন ধর্মাবলম্বী, তাই এই মন্দিরটিও জৈন মন্দির। মন্দিরটি আদিনাথ মন্দির বা পরেশনাথ মন্দির নামে পরিচিত। আদিনাথ হলো জৈন ধর্মের প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভনাথের আরেক নাম। মন্দির টি প্রথম থেকে এখানে ছিলো না ১৮৭৩ সালে তৎকালীন বাড়িটির মালিক তার মায়ের ইচ্ছা তে এটি বানান। আর এই বাগানবাড়ি টি তৈরী করান বর্তমান জিয়াগঞ্জ শ্রীপত সিং কলেজের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীপত সিং দুগরের পূর্বপুরুষ লক্ষীপত সিং দুগর (১৭৮০-১৭৮২ সালের মধ্যে) । তারা চার ভাই ছিলেন - লক্ষীপত সিং দুগর, ধনপত সিং দুগর, মহীপত সিং দুগর ও জগপত সিং দুগর। তারা এখানে ব্যাবসার সূত্রে এসেছিলেন। বিভিন্ন কাঠের ব্যবসা করার জন্য ও প্রচুর পরিমাণে গোলাপের চাষ হবার কারণে এর নাম দেওয়া হয় কাঠগোলাপ বাগান। পরে মানুষের মুখে মুখে এটি কাঠগোলা বাগানবাড়ি নামে খ্যাতি অর্জন করে। এখানে এসে তখনকার সব থেকে ধনী ব্যাবসায়ী জগৎ শেঠের সঙ্গে তাদের ভালো সম্পর্ক হয়। সেই সুবাদেই তৎকালীন নবাবের কাছে মাত্র ১২০০ টাকায় ২৫০ বিঘা জমি কিনে নেন। তার পরই তৈরী করান এই বাগান বাড়ি টি। সিংহদ্বার দিয়ে প্রবেশের পরে পরেই যে চারজনের অশ্বারোহী মূর্তি দেখা যায় সেগুলো এদের ই চার ভাইয়ের। বর্তমানে লক্ষীপত সিং দুগরের দশম প্রজন্ম সঞ্জয় সিং দুগর ও সিদ্ধার্থ সিং দুগর এই প্রাসাদটির দেখাশোনা করেন। তারা বর্তমানে কলকাতায় থাকেন। আসার সময় মুখ্য বাড়িটির পিছনে যে ভগ্নাবশেষ টি দেখা যায় সেটা অতীতে অতিথিশালা ছিলো। বাড়িটির সামনে যে পুকুর টা আছে তার বিপরীত পাড়ে এলে সেখান থেকে বাড়িটির অসাধারণ দৃশ্য চোখে পড়ে। আহা! কি সুন্দর দৃশ্য মন জুড়িয়ে যায়।
এবার আসা যাক সুড়ঙ্গের কথায়। এখানকার গুপ্ত সুড়ঙ্গ টি ইংরেজদের চোখে ধুলো দিয়ে লুকিয়ে ব্যাবসা করার জন্য বানানো হয়েছিলো। এই সুড়ঙ্গ টি সরাসরি চলে যায় এখান থেকে প্রায় চার কিমি দূরে জগৎ শেঠের বাড়ি। এই সূত্রে বলে রাখা ভালো জগৎ শেঠের পুরোনো এবং বড়ো বাড়িটি কিন্তু গঙ্গা নদীর তলায় তলিয়ে গেছে। আর তাই এই সুড়ঙ্গ টি সবসময় জলমগ্ন থাকে। এমনকি গঙ্গা নদীর জল বাড়লে এই সুড়ঙ্গের জলস্তর ও বারে আর কমলে কমে। জগৎ শেঠের যে বাড়িটা নদীর গর্ভে তলিয়ে গেছে তার তুলনায় এখন যে বাড়ি টি বর্তমান সেটি খুবই ছোট।
চলুন এবার চিড়িয়াখানায় সম্পর্কে কিছু জানা যাক।
কয়েক বছর আগে পর্যন্ত চিড়িয়াখানা টাও ঐ অতিথিশালার মতো ভগ্নাবশেষ হয়ে পড়েছিলো ইদানীং এটিকে ঠিক করা হয়েছে। আগে যখন চিড়িয়াখানাটা ঠিক ছিল তখন এখানে বাঘ, সিংহ বা কোনো মাংষাষী পশু রাখা হতো না। কারন এদের রাখলে তাদের মাংস খেতে দিতে হবে, আর জৈন রা তাদের বাড়ির চৌকাঠে পর্যন্ত মাংসের স্পর্শ পড়তে দেয় না।
ভিতরে গিয়ে দেখতে পাবেন সুন্দর সুন্দর পাখি। বিভিন্ন দেশের পাখি আছে সেখানে, এমনকি উট পাখিও আছে। এছাড়াও খরগোস, বিভিন্ন মাছ, হাঁস বিভিন্ন প্রাণী আছে ।
(লিখেছেন- বিমান চন্দ্র দাস । ভুল ত্রুটি হলে জানাবেন আমরা সেটি বিবেচনা করে দেখবো ।
কেমন লাগলো অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন ।
নমস্কার 🙏)