Tuesday, August 23, 2022

মা মৌলীক্ষার মন্দিরের ইতিহাস/বীরভূম লাগোয়া ঝাড়খন্ডের মলুটির মা মৌলীক্ষা

 তারাপীঠের মা তারার বড়ো বোন হন বীরভূম লাগোয়া ঝাড়খন্ডের মলুটির মা মৌলীক্ষা। মহুল গাছে ঘেরা মলুটি গ্রাম, ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলার দুমকা মহকুমার শিকারীপাড়া সিডি ব্লকের একটি ছোট্ট সুন্দর নিরিবিলি গ্রাম। এটি পূর্বে বাঁকুড়ার মল্ল রাজাদের অধীনে ছিল, নাম ছিল মল্লহাটি; অতঃপর হয়ে ওঠে মুলুটি। সেই সময়ে মল্ল রাজাদের দ্বারা শাসিত এই অঞ্চলটির বিস্তার ছিল উত্তরে বর্তমান পাকুড়, পূর্বে বর্ধমান, দক্ষিণে মেদিনীপুর এবং পশ্চিমে ছোট নাগপুর মালভূমির কিছু অংশ নিয়ে, এই অঞ্চলকে মল্লভূমও বলা হত। রামপুরহাট থেকে এই গ্রামের দূরত্ব মাত্র ১২ কিমি, দুমকা এখান থেকে ৫৫ কিমি দূরে।


চতুর্দশ শতকের মল্ল রাজাদের ঘাঁটি, মল্লহাটি আজ মলুটি নামে পরিচিত, এই মল্ল রাজারা ছিল বিষ্ণুপুরের শাসনকর্তা। গ্রামের ধার দিয়ে চুমড়ে আর চন্দননালা বয়ে চলেছে। এখানে বাঙালির সংখ্যা বেশি হলেও এখানে আদিবাসী বসতি দেখতে পাওয়া যায়, বিশেষ করে ওঁরাও উপজাতি। তারপর সুলতানী যুগে এই সকল অঞ্চল মুসলিম শাসকদের অধিকারে চলে যায়। সপ্তদশ শতকে ঘটে যায় অভূতপূর্ব এক ঘটনা, যার ফলে মলুটি এক সাধারণ বঙ্গ সন্তানের শাসনাধীন হয়ে ওঠে। আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে বসন্ত রায় বলে এক গরীব ব্রাহ্মণ বাস করতেন বীরভূম জেলার ময়ূরেশ্বরের কাছাকাছি কাটিগ্রামে। পিতৃহারা বসন্ত লোকের গরু-বাছুর চরিয়ে দিন কাটাতেন। একদিন মাঠে গরু চরাতে গিয়ে বালক বসন্ত গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এদিকে বেলা যত বাড়তে থাকে,  বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের আলো এসে তার মুখে পড়ে, একটি বিষধর সাপ হঠাৎ কোথা থেকে এসে বালকের মুখে রোদ পড়তে দেখে, তার ফনা তুলে  বালকটিকে আড়াল করে;  সেইসময় ঐ পথে কাশীর সুমেরু মঠের মোহান্ত দণ্ডীস্বামী নিগমানন্দ মহারাজ যাচ্ছিলেন। তিনি এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে বালকটির কাছে এগিয়ে যেতে, সাপটি তৎক্ষণাৎ পালিয়ে যায়। বালকটিকে ডেকে, তাকে নিয়ে তার মায়ের কাছে বলেন, যে তার ছেলের রাজযোগ রয়েছে, খুব শীঘ্রই তার ছেলে বসন্ত রাজা হবে।

 নিগমানন্দ মহারাজের সেই ভবিষ্যত বাণী বিফলে যায়নি। 


এই ঘটনার কিছুদিন পর, গৌড়ের বাদশা আলাউদ্দিন হোসেন শাহ উৎকল দেশ জয় করে ফেরার পথে কাটিগ্রাম থেকে কিছু দূরে ময়ূরাক্ষীর ধারে তাঁবু ফেলেছিলেন। হঠাৎ একদিন তাঁর বেগমের প্রিয় পোষ্য বাজপাখি সোনার শিকল কেটে পালিয়ে যায়। পাখির শোক বেগম সাহেবা কিছুতে ভুলতে পারছিলেন না, তাই সম্রাট ঘোষণা করেন, যে ব্যক্তি ঐ পাখিটি ধরে এনে দেবে, তাকে তার ইচ্ছে অনুযায়ী যা চাইবে, তাই দেবেন।  এদিকে সেই বাজ পাখিকে বন্দী করলো বসন্ত, সে পাখিটির জন্য  ফাঁদ পেতেছিল। পাখিকে নিয়ে বসন্ত, বাদশার কাছে গেল, বাদশা খুশি হয়ে বসন্তকে  পরদিন সূর্যোদয় থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ঘোড়ায় চেপে গ্রামে ঘুরতে বললেন।  যতটা সে ঘুরতে পারবে, ততটাই জমি সে পাবে 'নানকার' অর্থাৎ করহীন জমিদারি রূপে। এইভাবেই বসন্ত হলেন অধুনা ঝাড়খণ্ডের নানকার রাজ্যের রাজা এবং বাজপাখি ধরে দেওয়ার জন্য তার নাম হলো 'বাজ বসন্ত'।


এই বসন্ত রায়ের পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম মলুটিতে তাঁদের রাজধানী স্থাপন করেন। এই বংশের সকল রাজা ছিলেন শিবের ভক্ত। তারা প্রায় প্রত্যেকেই এখানে শিবের জন্য দেউল বা মন্দির গড়ে তোলেন বছরের পর বছর ধরে। দীর্ঘ একশো বছর ধরে,নানকার গড়ে ওঠে অসাধারণ টেরাকোটা স্থাপত্যের ১০৮টি শিব মন্দির। তবে, এই মন্দিরগুলি  এক সাথে নয়, পুরো গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।  কালের প্রবাহে, বর্তমানে এই ১০৮টির মধ্যে ৭২টি আজ অক্ষত রয়েছে, বাকি সব ধ্বংস হয়ে গেছে। এই ৭২টির ভেতর ৫৭টি চারচালা ঘরানার। বাকিগুলি রেখ দেউল, রাসমঞ্চ, সমতল ছাদ কিংবা একবাংলা। মন্দিরগুলির ভগ্ন দশার মধ্যেও এখনো কিছু কিছু  অপরূপ টেরাকোটার কার্যের শিল্পসুষমা বিদ্যমান। কোথাও মহিষাসুরমর্দিনীর চিত্র, কোথাও রামায়ণ, কোথাও রাম রাবণের যুদ্ধ, কোথাও মহাভারতের বিভিন্ন চিত্র, শিব দুর্গা, বিষ্ণু মূর্তি,  ফুল-লতা-পাতার টেরাকোটার মোটিভগুলি নজর কেড়ে নেয়। মন্দিরগুলির দরজার খিলানের উপর অংশে সংস্কৃত ভাষায় মন্দিরের প্রতিষ্ঠালিপি খোদিত রয়েছে। ইউনেস্কো মলুটিকে হেরিটেজ ভিলেজ আখ্যা দিয়েছে, কিন্তু সঠিক সংরক্ষণের অভাবে আজ মন্দিরগুলির বহুমূল্যবান প্রাচীন টেরাকোটার শিল্পকর্মগুলি ধ্বংসের পথে। মন্দিরগুলোতে দেবতা শিব থাকলেও, মাত্র কয়েকটা মন্দিরে পূজা হয়,বাকি ভগ্নপ্রায় হয়ে পড়ে রয়েছে। 


মলুটির প্রধান আকর্ষণ মা মৌলীক্ষার মন্দির। ১৮৫৭ সালে, মহাসাধক বামদেব এখানে একজন পুরোহিত হতে আসেন কিন্তু তিনি সংস্কৃত মন্ত্রগুলি মুখস্থ করতে পারেননি বলে ব্যর্থ হন। তাকে এখানকার একটি বিষ্ণু মন্দিরে পুজোর ফুল জোগাড় করার ও ভোগ রান্না করার চাকরি দেওয়া হয়। এখানে তিনি ১৮ মাস থেকে ছিলেন, তিনি এখানে থাকার বেশিরভাগ সময় মৌলীক্ষা মন্দিরে কাটাতেন। এখানেই তিনি প্রথম সিদ্ধিলাভ করেন, তারপর তারাপীঠের শশ্মানে সিদ্ধি লাভ করেন। তাঁর ব্যবহৃত ত্রিশূল, শঙ্খ এখনও মলুটিতে সংরক্ষিত আছে। তিনি মলুটির দেবী মৌলীক্ষাকে বড় মা ও তারাপীঠের তারামাকে ছোট মা বলতেন।  সেই থেকেই দেবী মৌলীক্ষাকে সবাই বড় মা বলে থাকেন।


মৌলীক্ষা: গ্রামের দক্ষিণ দিকে গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মা মৌলীক্ষার মন্দির। ‘মৌলি' শব্দের অর্থ মস্তক আর ‘ইক্ষা' শব্দের অর্থ দৃশ্যমান; অর্থাৎ, মৌলীক্ষা শব্দের অর্থ দৃশ্যমান মস্তক। মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবীর বিগ্রহ বলতে লাল ল্যাটেরাইট পাথরে খোদাই করা দেবীর মুখমণ্ডল শুধু দেখতে পাওয়া যায়, কোনো অবয়ব নেই। দেবীর ত্রিনয়ন রূপার তৈরী। মূর্তির গড়নে বজ্রযানী বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব সুস্পষ্ট। বৌদ্ধ তান্ত্রিক বজ্রযানীদের আরাধ্যা দেবী সিংহবাহিনী এখানে দেবী মৌলীক্ষা। মনে করা হয়, এই দেবী বজ্রযানী বৌদ্ধদের পূজিতা দেবী ছিলেন। কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রাচীন মন্দিরটি মাটির তলায় চাপা পড়ে যায়। পরবর্তীকালে, স্বপ্নাদেশ পেয়ে নানকার রাজা রাখরচন্দ্র, দেবী মৌলীক্ষার বিগ্রহ উদ্ধার করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই দেবী দুর্গারই একটি রূপ, দেবীর বাহনও সিংহ। দুর্গা মন্ত্রে দেবীর পূজা হয়।


আশ্বিনের শুক্লা চতুর্দশীতে বণিক জয়দত্তের তারামায়ের শিলা মূর্তি শ্মশানের শ্বেত শিমূল বৃক্ষের তলা থেকে উদ্ধার করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে ঐদিন তারা মায়ের মহাপুজা অনুষ্ঠিত হয় তারাপীঠে। একবার নানকার রাজা রাখড়চন্দ্র, ঐ বিশেষ দিনে, তারাপীঠে পুজো দিতে এসেছিলেন।সেইদিন প্রথামতো মন্দিরের নাট মন্দিরে মায়ের বিগ্রহকে এনে পূর্বমুখী করে বসিয়ে পূজা করছিলেন মন্দিরের পুরোহিতরা। কিন্তু তারাপীঠের মন্দিরে রাজাকে দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রাখেন নাটোরের রানীর কর্মচারীরা। রাজাকে পূজা দিতে বাঁধা দিয়ে তাঁকে একপ্রকার তাড়িয়ে দেন মন্দিরের কৌল সন্ন্যাসীরা।  তারা মায়ের পূজা দিতে না পেরে হতাশায় কাঁদতে কাঁদতে শেষপর্যন্ত  দ্বারকা নদীর ধারে ঘট প্রতিষ্ঠা করে দেবীর পুজো করেন তারা মায়ের পরম ভক্ত রাজা রাখড়চন্দ্র। তারপর এ কী কান্ড!!!  তারা মায়ের মন্দিরে পূজার সময় বিরামমঞ্চ থেকে তারা মায়ের মুখ আপনা থেকেই পশ্চিমমুখী হয়ে গেল, যেদিকে তাঁর ভক্ত রাজা পূজা করছিলেন ঠিক সেই পানে। সবাই আশ্চর্য হয়ে গেল এই ঘটনায়, জয় তারা জয় তারা বোলে চারদিক মুখরিত হলো। মা তাঁর ভক্তের পূজা ঘটেই নিলেন সেইদিন, মন্দিরে নয়। এদিকে সেইদিন নাটোরের রাণীকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে মা তারা বলেন, মন্দিরে তাঁর পুজো সম্পন্ন হয়নি। রাণী তখন মন্দিরের কর্মচারীদের নিকট ঝাড়খণ্ডের রাজার ঘটনাটি শোনেন। তৎক্ষণাৎ, রাণী ঝাড়খণ্ডের রাজার কাছে দূত পাঠিয়ে তারা মায়ের পূজা দিতে যাওয়ার অনুরোধ করেন।  রাজা এসে মা তারার পূজা করেন আনন্দ সহকারে। তারপর রাজাকে মা মৌলীক্ষা স্বপ্ন দিয়ে মলুটি গ্রামে তাঁর অবস্থানের কথা বলেন; রাজা মায়ের মন্দির স্থাপন করেন। পরে মা তারা, তারাপীঠের এক পুরোহিতকে স্বপ্নে নির্দেশ দেন, আশ্বিন শুক্লা চতুর্থীর দিন যেনো তাঁর বিগ্রহকে পশ্চিমমুখো করে বসানো হয়। আজও সেই নির্দেশ মেনে চলা হয় এবং ঐদিন মলুটি গ্রামে দেবী মৌলীক্ষার পুজো শেষে তারা পীঠে মা তারার পূজা শুরু হয়। কালী পূজার সময় মলুটি গ্রামে প্রায় শতাধিক কালী বিগ্রহের পূজা খুব ধুমধাম করে হয়।


রামপুরহাট বা মল্লারপুর থেকে গাড়ি ভাড়া করে আধ ঘণ্টার পথে মলুটি যাওয়া যায়। দুমকা হয়েও এমনকি ম্যাসাঞ্জোর হয়েও মলুটি যাওয়া সম্ভব। মলুটিতে থাকার জন্য আছে, ঝাড়খণ্ড পর্যটন দপ্তর এবং দুমকা জেলা পরিষদের দুটি সরকারি বাংলো। আগে থেকে জানালে ভোগ খাওয়ার ব্যবস্থাও মন্দিরের পক্ষ থেকে করা হয়।


কলমে :- মৌমিতা মন্ডল

ভার্গবী পত্রিকার সহ সম্পাদক  ও মূখ্য উপদেষ্টা

প্রকাশিত বই:- 

1)নবরূপে সতীপীঠ, প্রকাশক : বিন্দু বিসর্গ পাবলিশার্স

2)নীলাচলে রথযাত্রার ইতিহাস ও মাহাত্ম্য, প্রকাশক : বিন্দু বিসর্গ পাবলিশার্স

No comments:

Post a Comment