সেভাবে কোনোদিনই প্রচারের আলোয় না আসলেও বরাবরের মতো এবারেও এলাকার মানুষের আবেগ নিয়ে 222 তম বছরে পূজিত হচ্ছেন দেবী। হ্যাঁ ,কৈলঠা বাড়ির পুজো। মুর্শিদাবাদের এই এলাকা বরাবরের জন্য গরদ সিল্কের জন্য প্রসিদ্ধ। শুনেছি পারিবারিক সিল্কের ব্যবসায় একসময় সমৃদ্ধ ছিল পরিবারটি। বৃটিশদের সাথে কোনো এক মামলায় জয়ী হওয়ায় পুজো শুরু হয়। পাড়ার বয়স্কদের কাছে শুনেছি আগে মাটির এবং বাঁশের ঘরে পুজো হত। পরবর্তীতে প্রায় একশো বছর আগে এই মন্দির টি নির্মিত হয়। যে কটি পুরোনো বস্তু থেকে সময় ধরা হয় সেগুলি বর্তমানে ব্যবহৃত না হলেও যত্ন করে সংরক্ষিত আছে। আর অন্যান্য প্রাচীন পুজোর মতই নানা গল্পকথা এই পুজোর সাথেও জড়িত আছে। পুরোনো মানুষ জন এবং পুজোর সঙ্গে জড়িত অনেকেই আর সেই সব কাজের সাথে যুক্ত নেই । তবুও সেই ঐতিহ্য ও ঘরাণা আজও লালিত হচ্ছে মর্যাদার সাথে। শিল্পিও নানান সময় বদলেছে, কিন্তু প্যাটার্নটা অদ্ভূত ভাবে মিলে যায়। কুড়ি বছরের নানান ছবি সেটার সাক্ষী।
সেভাবে কখনোই কোনো উৎসবে না মাতলেও এই কটা দিন নানান দায়িত্ব সামলাতে ও পরিবার পরিজন ও এলাকার মানুষজনের সাথে একাত্ম হতে বেশ লাগে।
আমার সকল বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানালাম , পুজোতে প্রতিমা দেখার পাশাপাশি আমাকে তোমাদের আনন্দের অংশীদার হওয়ার সুযোগ দিতে। তথাকথিত "কাগুজে" বনেদিয়ানা নাই বা থাকল , মানুষের আবেগের ভীতটা তো আছে!
আমি এধরনের পোস্ট করতে অভ্যস্ত নই। বিশেষ করে পুজো পার্বনে বা কোনো অনুষ্ঠানে। তবু পারিবারিক পুজো উপলক্ষে কিছু কথা ,ভাবনা যেভাবে মনকে পীড়া দেয় তা ভাগ করে দিতেই একটু চেষ্টা। আসলে কোনো উৎসব অনুষ্ঠানে যাঁরা না থাকলে উৎসবের কোনো আঁচই মনে আসে না তাঁদের কথা বার বার মনকে নাড়া দেয়।
যেটা বলতে চাইছিলাম, আমি আমার বাড়ির পুজোকে বনেদি বাড়ির পুজো বলব এতটা আঁতেল আমি নই। কিন্তু একে ঘিরে যে স্মৃতি আমার মনে থেকে গেছে তা রীতিমতো বিষ্ময়ের।আগেই বলেছি পুজোটা দুশো বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে । ফলে জন্মঅবধি দেখেছি কাকু জেঠু বাবারা একসাথেই পুজো করছেন । পুজোর সঙ্গে যুক্ত নানান মানুষ জন আশেপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসতেন। এমনি একজন মানুষ কে দেখেছি আমার আট দশ বছর বয়স থেকে পুজো করতে আসতেন । শুনেছি তাঁর পিতাও আসতেন এই বাড়িতে। "বৃন্দাবন ভট্টাচার্য" মুর্শিদাবাদ বাদ জেলার তাঁতিবিড়োল গ্রামের একজন বড় জমিদার শ্রেনির মানুষ , আদতে দীর্ঘদেহী সুপুরুষ যিনি আমাদের সবার "ঠাকুর দাদু "। আমার এসব কথা পড়লে বন্ধুবান্ধবেরা সবাই কিভাবে নেবে জানিনা,কারন তাদের চোখে আমি নাকি কিছুটা নাস্তিক গোছের । অনেকে আমাকে রাগ করে জড়বাদী বলত একসময়। কিন্তু তাই বলে পুরোনো ইতিহাস, আবেগ ,জনশ্রুতি তাকে এড়াব কি করে? যেকথা বলছিলাম ,বৃন্দাবন দাদুর পুজোর মন্ত্রোচ্চারণ , কন্ঠস্বর যে কোনো নারী, বিশেষ করে যাঁরা পুজো দিতে আসছেন তাদের হৃদয়ে তো দাগ কাটতোই , বড় বিচক্ষণ মানুষেরাও বাদ যেতোনা। তাঁর আরতির মাঝে নৃত্য , সন্ধিপুজোর মাঝে অমিতাভ বচ্চনের আওয়াজে বিরেন্দ্রকৃষ্ণ এফেক্টের চন্ডীপাঠ আমার কিশোর মনেও রেখাপাত করেছিল। এক অদ্ভুত মানুষ ছিলেন বৃন্দাবন দাদু,চল্লিশ বছর আগে দক্ষিণা পেতেন নামমাত্র কিন্তু প্রতিবারই পরের বার আসবনা বলা সত্বেও ঠিক সময়ে গরুর গাড়ি চড়ে চলে আসতেন। কটাদিন পাড়া মাতিয়ে দশমীর দিন সবাই কে কাঁদিয়ে বিদায় নিতেন। যত বড় হয়েছি দাদুর প্রতি আকর্ষণ তত বেড়ে গেছে। আগেই বলেছি বনেদি পুজো না বলেও একটি প্রাচীন সাবেকি পুজোর তকমা দেওয়াই যায়। দীর্ঘ সময় পরিবারের সবাই মিলে একসাথে পুজো করলেও একটা সময় সেটাও ধাক্কা খেল। এখানেই টুইস্ট। আসলে 'পুরোহিত' দাদু যখন আমাদের পুজোতে আসতেন তখন পাঁচটা দিন আমার একশো কুড়ি বছরের ঘর থেকে আমাদের বের করে দিতেন । আমরা অর্থাৎ আমি আর ঠাকুমা। বরাবরই দোতলা বাড়িটার একতলার ঘরে থাকতাম। প্রসঙ্গত আজও সেখানেই আছি। কিন্তু দেখতাম ষষ্ঠীর দিন দাদু এসে খাট দখল করে নিতেন । আর আমি এবং ঠাকুমা পুজোর ঐ কটা দিন কাটাতাম দক্ষিণ দিকের মাটির ঘরটায়। খুব রাগ হতো তখন। ব্যাপারটা আরো মাত্রা পেত যখন দেখতাম অন্য শরিকের বেলাতেও দাদু স্বস্থানে। কিন্তু অবাক লাগত জোরটা দাদু কোথা থেকে পেতেন! পরবর্তীতে পুজোর ভার পাইকর হয়ে রামপুরহাট চলে গেছে কিন্তু ঘর থেকে বের করে দেবার মতো জোরটা খুব মিস করি। সেই দিন গুলো আর কোনোদিন ফিরে আসবে না ঠিকই কিন্তু গল্পগুলো নতুন প্রজন্ম জানলে আত্মকেন্দ্রিকতার সময়ে কিছুটা হলেও ইনস্পিরেশন পাবে।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEit6PEdEVpQw2u11XJAmhlcvCyvwa8LEU-iu7p0_PG7VUC_lgq_c0TO_73Pryl2yp2yQuc3mEAzyevz4rKbZEopFURoz6-L7V5T2mgj7K5e1qcficDjcw3bX2e00xEkdpNKHysMu2dd5Bq4oDkRLZs3oJGCj5Oay4gNPl6GpeRedZm7TxvHjqkNjZ-rFA/w414-h330/WhatsApp%20Image%202022-09-08%20at%207.10.14%20PM%20(1).jpeg)
আজকে একটু আলাদা বিষয়ে বলি। দূর্গাপুজোর যে সকল সামগ্রী লাগে তা যোগাড় করা এখন অনেক সহজ বলে মনে হয়। কিন্তু একটা সময় দেখেছি কোথাও সমুদ্র দেখতে যাচ্ছি শুনলেই ঠাকুমা শিশি ধরিয়ে দিতেন জল আনার জন্য। পরে কখনো দেখতাম বোতলে করে বৃষ্টির জল ধরছেন। অনেক সময় আদিক্ষেতা মনে হলেও পরে বুঝতাম আন্তরিকতা কতখানি ,না হলে একটা একটা করে শিউলি ফুলের বোঁটা ছিঁড়ে কেউ রঙ তৈরী করতে পারে! (যেটা 'অষ্টদল পত্র' তৈরীতে লাগে) এই কটা দিন গোটা পরিবারের মহিলারা যে অমানুষিক পরিশ্রম করেন তা বলবার নয়। নইলে পরিবারের আধুনিকারা, তা সে বাড়ির মেয়েই হোক বা বৌমা কাউকে এই কটা দিন সেভাবে মাঞ্জা দিতে দেখিনা। অবশ্য শেষ বেলায় বিজয়ার আগে তারা যে সেরাটা দেবেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। তো যে কথাটা বলছিলাম বাড়ির কথা তো বললাম কিন্তু জন্মঅবধি যাকে দেখছি, যার বয়স বাড়েনা, সেই সুশীলকাকু" ফুল বেলপাতা অশোক ছাতিম যাবতীয় চাহিদার একমাত্র ভরসা পুজো পরিচালনার সিংহভাগ ভার অবলীলায় সামলে দেন। আসেন আট কিলোমিটার দুরের গ্রাম থেকে। আসলে একটা উৎসব যখন এত এত মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয় তখনই শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে। এই পুজোয় নানান রেওয়াজ আছে তার বেশিরভাগ কারনই খুঁজে বের করেছি । যেমন , কলাবৌ এর বিভিন্ন উদ্ভিদ এর সাথে ব্যবহৃত একটি দন্ড। যা অন্য কোথাও দেখি না। কিন্তু এখানে এটা ব্যবহারের কারন গরদ শিল্পের সঙ্গে দন্ডটির যোগ। সেটি আবার আসে প্রতিবেশির বাড়ি থেকে। কিন্তু কলাবৌ যেখানে গনেশের দিকে থাকে এক্ষেত্রে সেটি জন্মঅবধি দেখছি কার্তিকের দিকে! আজও বুঝিনি।
ও হ্যাঁ এই কদিন লেখাগুলো লিখছি এক ভাই এর অনুরোধে । কোনো মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য নয়।
তাই কেউ যেন "ডিজিট্যাল ঈর্ষার" শিকার না হন। আপনারা নিচ্ছেন বলেই লিখতে আগ্রহ পাচ্ছি।
কৈলঠা বাড়ির দূর্গাপুজো পুজো কি কখনো কারো হয়? আয়োজক মাত্র। আসলে উৎসবের শ্রেষ্ঠত্ব সেখানেই যখন বহু মানুষের ইনভলভমেন্ট উৎসবের সাথে যোগ হয়ে যায়। যে এলাকায় এই পুজো টি হচ্ছে সেটি মুলত একটি গ্রাম। কিন্তু সাংস্কৃতিক চেতনায় যে "স্টেটাস" বহন করে তাতে যে কোনো নিন্দুকের 'বাক বন্দি' হয়ে যেতে পারে। ও হ্যাঁ এ প্রসঙ্গে বলি একজন অধ্যাপক মহাশয়ের পদবী সংক্রান্ত একটি গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে জানা যায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বিভিন্ন পদবীর সাথে নানান সংস্কৃতিরও মেলবন্ধন এখানে ঘটেছে। ফলতঃ বহুদিন যাবৎ এই পুজোটির সাক্ষী হয়ে মানুষজন পুজোটির সাথে একাত্ব হয়ে গেছেন। তিন কিলোমিটার দুর থেকে মঙ্গলঘট নিয়ে গ্রামের ভিতরে প্রবেশ করার সময় নারীপুরুষ নির্বিশেষে ধূপধুনো নিয়ে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে স্বাগত জানানোর দৃশ্য যে কোনো চিত্রপরিচালকের মেটিরিয়াল হয়ে যাবে।
কদিন আগে এই পুজোটি সংক্রান্ত লেখায় একজন বলছিলেন এই পুজোটি যেন এলাকার GMT। বাস্তবিকই তাই। আর হবে নাই বা কেন। সময়, নির্ঘন্ট, নিয়ম,উপাচার এসব যত্ন করে খেয়াল রাখাও যে আয়োজকদের দায়িত্ব। ভাবা যায় এই গ্রামের কয়েকটা এলাকার মানুষ রাত্রে দেবীর নীরঞ্জন না হওয়া পর্যন্ত অন্ন পর্যন্ত গ্রহণ করেন না। যাকে বলে "সেফ ডিপারচার"। সেই খবর নেবার পর অন্নগ্রহণ। আমি তো রীতিমতো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি ব্যাপারটা শুনে।
"মির্জাপুর" এলাকাটি অত্যন্ত আকর্ষণের জায়গা। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও যথেষ্ট। ছোটবেলার থেকে দেখেছি বাজি পোড়ানোর হিড়িক। রীতিমতো প্রতিযোগিতা হতেও দেখেছি। বিষাদের বিজয়াতেও যথেষ্ট উন্মাদনা থাকে সব জায়গার মতোই। বিজয়ার সময় একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল। যা এই প্রজন্মের কাছে এরকম আত্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে চ্যালেঞ্জের। সেবার বিসর্জনের সময় প্রতিমা বেদি থেকে নামানোর পর বরণ পর্ব শেষ করে গয়না খুলে "বেহারা"র কাঁধে চড়ে সবে বাড়ির চৌহদ্দি পেরিয়েছে , হঠাৎ দেখি প্রতিমার হাতগুলো শুধু কাঠামোর সাথে লেগে আছে, বাকি সম্পূর্ণ দেহ মাটিতে। ব্যাস,খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। বাড়ির মহিলারা তো আছেনই গ্রামের সমস্ত মানুষ সেদিন বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে ছিলেন। কিন্তু তাতে অবাক হইনি, অবাক হয়েছিলাম সেই আবেগ দেখে যার জন্য দীঘির ঘাট পর্যন্ত সম্পূর্ণ রাস্তায় আর একটি বাজিও সেদিন কেউ ফাটায়নি। সম্পূর্ণ রাস্তায় শ্মশানের নিস্তব্ধতা।
মাঝবয়সের একটি স্মৃতি মনকে খুবই নাড়া দিত । কিছুটা অবাকও হতাম। প্রতিমা নিয়ে যখন ঘাটে পৌঁছতাম , দেখতাম গ্রামের অন্য প্রতিমা নিয়ে অন্য পাড়ার মানুষেরা অপেক্ষা করছেন। আবার মাঝপথে চৌধুরী বাড়ির দেবী চৌধুরী বাড়ির কাছে "বড় ভগবতী" পৌছানোর সাথে সাথেই সঙ্গ নিত। কি যে মজা পেতাম সেদিন। গান গাইতে গাইতে প্রতিমা বাহকেরা কিছুটা এগোনোর পর হঠাৎ থেমে গিয়ে পিছিয়ে আসবার পর দেখতাম অত বড় প্রতিমা নিয়ে দৌড়চ্ছে। সে এক মজার ব্যাপার। কারনটা সেদিন না বুঝলেও অনেক পড়ে উদ্ধার করেছিলাম।
একটা কথা বলতেই হয়, বিগত কয়েক দশকে আর্থসামাজিক পরিস্থিতির বিস্তর পরিবর্তন হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই যারা প্রতিমা বহন করেন তাদের অনেকেরই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু তাদের কে স্যালুট জানাতেই হবে কারণ চল্লিশ বছর আগেও শুনেছি তাদের পূর্বপুরুষেরা ও এই কাজ করে এসেছেন আজও তারাও মেনে চলছেন। ও এঁরা হলেন পাশের একটি গ্রাম "দক্ষিণপাড়ার" বাসিন্দা।আজ পর্যন্ত এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। পূর্বপুরুষদের প্রতি সম্মান জানানোর এই রেওয়াজ প্রশংসার যোগ্য। পারিশ্রমিক দিয়ে এর মূল্যায়ন করা যাবে না। এই পুজোর সাথে জড়িত বিভিন্ন রেওয়াজ এলাকার মানুষের সাহায্য নিয়ে আজও পালিত হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু কৃষ্টি, সংস্কৃতি , রেওয়াজের ঐতিহ্য সবার আন্তরিকতাতেই রক্ষিত হয়। নতূন প্রজন্মের কাছে তা হয়তো উদাহরণ হয়ে থাকবে!
সবাই ভালো থাকো।