ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে.....
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় চমকে উঠলেন সত্যজিৎ রায়ের কথা শুনে।টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে সত্যজিৎ রায় তাকে জানালেন তিনি তার জলসাঘর খুঁজে পেয়েছেন।আসলে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় তার “জলসাঘর” চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যটা লিখেছিলেন।চিত্রনাট্য লিখে ফেললেও তিনি প্রকৃত জলসাঘর খুঁজে পাচ্ছিলেন না।পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের তিরিশটির উপর লোকেশন দেখে একটি জায়গাকেও পছন্দ না করতে পেরে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন।তখন কাকতালীয়ভাবে সত্যজিৎ রায় মুর্শিদাবাদের নিমতিতার জমিদারবাড়িটি আবিষ্কার করেন।কলকাতা ফিরে গিয়েই তিনি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে টেলিফোন করেন।তিনি জানান যে তাঁর মনের মতো জায়গা তিনি নিমতিতায় খুঁজে পেয়েছেন। বিস্মিত তারাশঙ্কর সত্যজিৎকে জিজ্ঞাসা করেন যে জায়গাটি উপেন্দ্রনারায়ন চৌধুরীদের জমিদারবাড়ি কিনা।সত্যজিৎ যখন বলেন যে, হ্যাঁ ঠিক সেই বাড়িটিই, তখন তারাশঙ্কর অবাক হয়ে যান।তিনি জানান যে তিনি নিজে কখনও নিমতিতায় যাননি।বাংলাদেশের জমিদারদের নিয়ে লেখা একটি ইতিহাসের বইতে তিনি ঐ পরিবারটির এবং সংগীতপ্রেমিক উপেন্দ্রনারায়ন চৌধুরীর কথা পড়েছিলেন।সেই চৌধুরী মশাইকে কেন্দ্র করেই তিনি বিশ্বম্ভর রায়ের চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন।লেখক ও চলচ্চিত্রকারের কল্পনার এই অদ্ভুত সমাপতনের ফল নিমতিতার জমিদারবাড়িতে চিত্রায়িত জলসাঘর।
জলসাঘরের বর্তমান অবস্থা দেখার জন্য সাত সকালেই রওনা দিয়েছিলাম।সকাল প্রায় এগারোটা। মুর্শিদাবাদের নিমতিতা স্টেশনে নামলাম।স্টেশনের বাইরে একটা টোটো গাড়ি যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল।সেটাতে চেপেই নিমতিতা জমিদারবাড়ির দিকে এগোলাম।মফস্বলের মধ্য দিয়ে মিনিট পনেরো-কুড়ি যাবার পর ড্রাইভার একটা আমবাগানের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে উঠল দাদা আপনার গন্তব্য ঐখানে।পাকা রাস্তা থেকে আমবাগনের মধ্য দিযে সরু পথ চলে গেছে।ততক্ষনে সূর্যদেব মাথার ওপরে ওঠার তোরজোড়ে ব্যস্ত। কিন্তু ঘুরতে এসে ক্লান্ত হলে চলবে না।চোখ দিয়ে সব বন্দী করে; মনের খাতায় লিখে রাখতে হবে।আমবাগান পার করেই এসে পৌঁছোলাম সত্যজিৎ রায়ের জলসাঘরের সামনে।
বাড়িটা বিরাট প্রাসাদের মতো।দোতলা হলেও উচ্চতায় অনায়াসে এখনকার চারতলার সমান।সামনের দিকে বড় বড় থাম আর নক্সাকাটা জাফরি।পুরানো বাড়িটা প্রায় ভাঙাচোরা।দেওয়াল থেকে অশ্বত্থচারা বেরিয়ে হাওয়ায় দুলছে।চারদিকে আগাছার ঘন জঙ্গল।বোঝা যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে পরিচর্যা হয়নি।আর সোজা তাকালে চোখে পড়ে সতত প্রবহবান গঙ্গা।প্রকান্ড এই জমিদারবাড়ির সামনে ধু ধু সাদা বালির চর।মাঝখান দিয়ে নীল সরু গঙ্গা বয়ে চলেছে।নদী থেকে দূরত্ব মেরেকেটে ৩০০ মিটারের মতো।নদীর ওপাশটা নাকি বাংলাদেশ।
নিমতিতা জমিদারবাড়ির বর্তমান পুরুষদের একজন রবীন্দ্র নারায়ন চৌধুরী। এখন কলকাতা নিবাসী।তার কাছ থেকে জেনেছিলাম এই বাড়ির দেখভাল করেন চপলা সিংহ।অগত্যা তার খোঁজ শুরু করলাম।একটি বাচ্চা মেয়ে পথ দেখালো।তাকে অনুসরন করলাম।ঝোপ-ঝাড় পেরিয়ে জমিদারবাড়ির ঠিক পেছনের দিকে এলাম। এখানে একটা হালফিল আমলের লোহার ছোট দরজা আছে। পেছনে একটা পুকুর।বাঁধানো ঘাটের বিশাল পুকুর পাড়।ঘাটের অনেক সিঁড়িই ভাঙাচোরা।পুরু শ্যাওলা জমে আছে সিঁড়িতে।বোঝা গেল এ সিঁড়ি খুব একটা কেউ ব্যবহার করে না।আগে হয়ত ওই দরজা দিয়ে বাড়ির অন্তঃপুরের মহিলারা এই পুকুরঘাটে আসত।
দারোয়ান! দারোয়ান! বেহারা! বেহারা! মহিম গাঙ্গুলির দাম্ভিক গলার আওয়াজে নায়েব তারাপ্রসন্ন বেরিয়ে এলেন।তাকে বসতে বললেন।মহিম গাঙ্গুলি হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটাকে ফেলে পায়ের তলায় মাড়িয়ে ঘুরতে লাগলেন। এমন সময় অনন্ত এসে বলল হুজুর আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের অনুমতি নিয়ে রায়বাড়িতে প্রবেশ করল মহিম গাঙ্গুলি।সত্যজিৎ রায়ের জলসাঘরের সেই দৃশ্যটা মনের মধ্যে ফুটে উঠল।কি অদ্ভুত! আমিও সেই রায়বাড়িতে প্রবেশ করলাম।কিন্তু এখন আর কোন অনুমতির দরকার পড়ল না।
পরিত্যক্ত বাড়ি।কোন রমরমা নেই।শতাধিক বছরের পুরানো।ছাদের দেয়াল ধসে গেছে, ইটগুলো বেরিয়ে আছে হা করে। পলেস্তরা খসে ইট বেরিয়ে পড়েছে প্রায় গোটা বাড়ির দেয়ালে।বট অশ্বত্থের চারা গজিয়েছে দেয়ালের কার্নিসে। কোনও কোনওটা বড়ও হয়েছে। জোরে হাওয়া দিলে ডালে পাতায় শন শন করে শব্দ হচ্ছে।মাঝে মাঝে চামচিকে আর মাকড়সার আড্ডা।মহিম গাঙ্গুলির কথাটা মনে পড়ল “একসময় কি ছিল এই রায়বাড়ি আর আজ কি হয়েছে!!” বাচ্চা মেয়েটা হাত ধরে টান দিতে হুস ফিরল আমার।তাকে অনুসরন করে একটা বাঁশের ভারা পার হলাম।একটা ঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়ার রাস্তা! বৃষ্টির সময় নাকি বাড়ির ভেতরে প্রায় হাঁটু জল জমে; তাই এই ব্যবস্থা।
একটা ভাঙাচোরা চাতালের সামনে এই জমিদার বাড়িতে একমাত্র বসবাসকারী চপলা সিংহের সাথে দেখা হল।পঞ্চাশ-ষাট ছুঁই ছুঁই।বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও দমে যাননি তিনি।তার থাকার ঘরে নিয়ে গেলেন।সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে শুনলাম সারা বাড়ির মধ্যে একমাত্র এই সিঁড়ি আর ওনার ঘরটাই কেবল অক্ষত আছে।ওপরের ঘরে উঠে একটা পালঙ্ক দেখতে পেলাম।যদিও তার অবস্থা তথৈবচ।পুরানো দিনের আসবাব বলতে একটা কাঠের আলমারি ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না।
ঘরের সামনে বারান্দা।সেখানে একটা মাটির উনুনে চপলা দেবীর মেয়ে রান্না করছেন।এখানেই হয়ত এককালে জমিদারগিন্নীর পাখার হাওয়ায় বসে জমিদার মধ্যাহ্নভোজন সারতেন।চপলা দেবী চাবির গোছা নিয়ে ঠাকুর-দালান দেখাবার জন্য সামনে পথ দেখালেন।যাওয়ার পথে একটা পুরানো ঘর তালাবন্দি অবস্থায় দেখলাম।ধুলো-পড়া শার্শি দিয়ে যতটুকু আলো চুপিসারে ঢোকে,তাতেই আবছা আবছা দেখলাম ক্ষয়ে যাওয়া ইটের দেওয়াল।ঘর ভর্তি শুধু ধুলো পড়া ভাঙাচোরা আসবাব ভর্তি।এই নিঃসঙ্গ নিস্তব্ধ বাড়িটিতে, যেন গ্রীষ্মের গনগনে তাপে চাপা গলায় তারা কাঁদছে৷সে কান্না কারোর কানে আসে না৷ক্ষয়িষ্ণু অবয়ব নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা৷
“সবই তো জল৷সব অতলে তলিয়ে গেছে, সব ভেসে গেছে,সব ভেসে গেছে”৷নায়েবের কাছে বেদনা জড়িত কন্ঠে বলেছিলেন জমিদার বিশ্বম্ভর রায়৷বাস্তবিক তাই৷
একটা অলিন্দ পেরিয়ে ঠাকুর দালানে এসে পৌঁছোলাম৷একসময় জাঁক-জমকপূর্ণ দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হতো এই জমিদার বাড়িতেই। জমিদার বাড়ির গৃহদেবতা গোবিন্দজির দোল উৎসবের সময় পনেরো দিন ধরে চলতো যাত্রাপালা।বসত মেলা।প্রতি বছর উৎসবে যাত্রা থিয়েটারের আসর বসতো নিমতিতায়।এই আনন্দ যজ্ঞে কলকাতার বিশিষ্ট শিল্পী ও সাহিত্যিকদের নিমন্ত্রণ থাকতো।একসময় বাংলার সমাজ জীবনে ও সংস্কৃতির উপর প্রভূত প্রভাব বিস্তার করেছিল নিমতিতা জমিদার বাড়ি।
এই জমিদার বাড়ির ইতিহাস প্রায় দুই শতাধিক বছরের পুরানো।এই বংশের আদি পুরুষ রামচন্দ্র চৌধুরী।গৌড়ের বাদশার কাছে কাজের সুত্রে তিনি পাবনা থেকে তাণ্ডায় আসেন।পরে সেখান থেকে রঘুনাথপুর, রঘুনাথপুর থেকে নহলামারী ও পরে বর্তমান নিমতিতা গ্রামে আসেন।এখানেই নিমতিতা জমিদারীর প্রতিষ্ঠা করেন।আনুমানিক ১৮৩৬ - ১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যেই এই নিমতিতা জমিদারীর প্রতিষ্ঠা।
ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষভাগে (১৮৯৭-৯৮) তৎকালীন জমিদার মহেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ‘নিমতিতা হিন্দু থিয়েটার’ নামে এক নাটকের দল প্রতিষ্ঠা করেন। তৈরি করেন নাট্যমঞ্চও। সেই সময়েই তিনি সেখানে ভোল্টের জেনারেটর ব্যবহার করেছিলেন কিন্তু মঞ্চে শব্দ হয় বলে মঞ্চের আলো নিয়ন্ত্রিত হতো স্টোরেজ ব্যাটারি দিয়ে।শুধু তাই নয় তার জন্য তৈরি করেছিলেন একটা ব্যাটারিঘর।
নিমতিতা মঞ্চের প্রথম নাটক গিরিশচন্দ্রের ‘নল-দয়ময়ন্তী’। পরবর্তী সময়ে ‘শঙ্করাচার্য’, ‘বিল্বমঙ্গল’, ‘চৈতন্যলীলা’. ‘প্রতাপাদিত্য’, ‘সাজাহান’, ‘নর-নারায়ণ’, ‘ভীষ্ম’, ‘আলীবাবা’ প্রভৃতি প্রযোজনা মঞ্চস্থ হয়েছে। ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ তাঁর বহু নাটক এই রাজবাড়িতে বসেই লিখেছেন। ‘নর-নারায়ণ’ লেখা হয় এই মঞ্চের জন্যই।‘ভীষ্ম’ নাটকের দ্বিতীয় সংষ্করণের ৮৯ পৃষ্ঠায় পাদটিকাতে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে- মুর্শিদাবাদ নিমতিতা হিন্দু থিয়েটারের জন্য এই অংশ লিখিত।মহেন্দ্র নারায়ণের সৃজনী প্রতিভার আকর্ষণে আমন্ত্রিত দর্শক হয়ে আসেন সে যুগের প্রখ্যাত নাট্যকার ক্ষীরোদ প্রসাদ, অপরেশ মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক মনমোহন বসু ও নাট্যাচার্য্য শিশির কুমার।একবার নিমতিতার এই রঙ্গমঞ্চে "আলমগীর" নাটক অভিনীত হয়।স্থানীয় দর্শকবৃন্দ ও নাট্যাচার্য্য শিশির কুমারের অনুরোধে ঔরঙ্গজেবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন মহেন্দ্র নারায়ণ।পরদিন একই নাটকে একই মঞ্চে একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন নাট্যাচার্য শিশির কুমার স্বয়ং।নাটক শেষে ক্ষীরোদ প্রসাদ মন্তব্য করেছিলেন ------- "দুই আলমগীরের দুটি রূপ প্রত্যক্ষ করিলাম"।মহেন্দ্র নারায়ণের ছোট ভাই জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণের বিয়ে উপলক্ষে কলকাতার স্টার থিয়েটার চার রাত্রির বায়না নিয়ে এখানে অভিনয় করতে আসে।এইসময় নিমতিতা বাংলার সংস্কৃতি ও নাট্যচর্চার এক নতুন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
চপলা দেবীর পিছু পিছু বাড়িটির উঠোনে প্রবেশ করতেই যেন ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে গেলাম। মনে হল অতীতে ফেলে আসা রঙিন উৎসব ও বনেদিয়ানার ছবি যেন চোখের সামনে ফুটে উঠল৷শঙ্খধ্বনি, উৎসব, বিয়ে-পার্বণে সুন্দরী রমণীদের লাল পেড়ে শাড়ি পরে আনাগোনা, আরামকেদারায় বসে রাশভারি গলায় গৃহকর্তার হুকুম জারি করা - সমস্ত কিছু৷কানে ভেসে এল সারেঙ্গীর আওয়াজ৷চারিদিকে যেন হৈ হৈ রব৷কিন্তু নিমেষের মধ্যে সে দৃশ্য প্রখর তাপে মিলিয়ে গিয়ে সামনে পড়ে রইল একরাশ ধুলো আর ঝুলে ভরা বারান্দা৷ঝকঝকে,সাজানো আসবাবপত্রগুলো মুহূর্তের মধ্যে কোথাও যেন উবে গেল৷
এই জমিদার বাড়ির খ্যাতনামা জমিদার গৌরসুন্দর চৌধুরী ও দ্বারকানাথ চৌধুরীর সময়ে জমিদারীর আয় বাড়তে থাকে।জমিদারীরর শ্রীবৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলার অন্যান্য জমিদার পরিবারের সাথে রক্তের সম্পর্ক স্থাপিত হয়।গৌরসুন্দর চৌধুরীর নাতনি সবিতারানীর সাথে রংপুরের জমিদার পরিবারের ফণীভূষণ মজুমদারের বিবাহ হয়।তাদের বর্তমান বংশধর অমিত মজুমদার।তিনি স্মৃতিচারন করতে গিয়ে নিমতিতার অতীত জৌলুসের কথা বললেন।তিনি ছোটোবেলায় চল্লিশের দশকে যখন ঘুরতে এসেছিলেন নিমতিতার বিখ্যাত নাট্যশালার কিছু অংশ দেখেছিলেন।গঙ্গার ভাঙনে আজ এই নাট্যশালা সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত।তার আর কোন চিহ্ন দেখতে পেলাম না।
গৌরসুন্দর চৌধুরীর সময় জমিদার বাড়িরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল৷গোকুল দাসের তত্ত্বাবধানে ইটালিয়ান ধাঁচে তৈরী এই বাড়ির ভিতর একসময় পাঁচটি উঠোন, দেড় শতাধিক কক্ষ, নাট মঞ্চ, ঠাকুর দালান ছিল।এখন বাড়িটা জনমানব শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে।বিরাট উঠোন। যে উঠোনটায় দাঁড়িয়ে আছি তার চারদিক ঘিরে বাড়িটা উঠেছে। ভুল বললাম, ভাল করে দেখলে বোঝা যায়, তিন দিকে একতলায় ছোট ছোট ঘর সম্ভবত রান্না ঘর,ভাঁড়ার ঘর, দাসদাসীদের ঘর ইত্যাদি আর দক্ষিণ কোনে কাছারি বাড়ি।জলসাঘর সিনেমার স্যুটিং-এর সময় এই কাছারি বাড়িরই দোতলায় আস্তানা ছিল ছবি বিশ্বাসের। সন্ধে হলে তিনি সেখানে নিজের পানীয় নিয়ে একঘরে হতেন। তিনি তখন নিজের জগতেই থাকতেন।এখন কাছারি বাড়ির দোতালার ছাদ বলতে আর কিছুই নাই।একতলায় বিরাট বিরাট ফোকরগুলো দিয়ে বাইরের ঝাপসা আলো ভেতরে এসে পড়ছে। সেদিকে তাকালে মনে হয়, কারা যেন ঘরগুলোর মধ্যে ওঁত পেতে বসে আছে যে কোনো মুহুর্তে তারা ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
বাংলা চলচ্চিত্রে আধুনিকতার ছোঁয়া এনেছিলেন সত্যজিৎ রায়। ইতিহাসের মেজাজ, সাবেকি পোশাক, রাগসঙ্গীত, নাচ আর ট্র্যাজেডির মেলবন্ধনের সাথে ছবি বিশ্বাসের অসামান্য অভিনয় জলসাঘরকে আজও আমাদের কাছে অমর করে রেখেছে।নখ দর্পণহীন জমিদার বিশ্বম্ভর বাবুর পতন নিয়ে গল্প।জমিদার বেঁচে আছেন কিন্তু জমিদারি আর নেই।তবুও প্রচন্ড দাম্ভিক বিশ্বম্ভর রায় চূর্ণ হবেন না, বংশ আভিজাত্যের দম্ভকে টিকিয়ে রাখতে তাই তিনি বিসর্জনের নেশায় মেতেছিলেন।তাঁর দম্ভ খুব একটা ধরা পড়ে না, যেটা পড়ে সেটা হলো তাঁর আত্মমর্যাদা বোধ।তবে এই বোধের অতিশায্য ডেকে আনে ভয়ংকর পরিনতি।
জীর্ণ বিবর্ণ নিঃশব্দ প্রাসাদের শ্বেত পাথরের সিঁড়ি বেয়ে বৃদ্ধ জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের হাতের কারুকার্য মন্ডিত লাঠিটি গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে এক নব্য উঠতি বিত্তশালী মহিম গাঙ্গুলির বাড়ি থেকে ভেসে আসছে সারেঙ্গীর আওয়াজ।শেষে জলসাশেষে সবাই চলে যেতে একে একে যখন বাতি নিভছে আর অন্ধকার ঘনাচ্ছে তখন দেওয়ালজোড়া বেলজিয়াম গ্লাসের আয়নায় বিশ্বম্ভর খুঁটিয়ে দেখছেন তাঁর শেষ হাসি হাসা মুখটা। তিনি নিঃস্ব হয়েছেন কিন্তু মহিম গাঙ্গুলির উঠতি বড়লোকি মেজাজকে ঢিট করেছেন। যান্ত্রিক সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে পরিবর্তনশীল সমাজের এই বৈপরীত্য তুলে ধরেছিলেন সত্যজিৎ রায়।
জলসাঘর দেশে-বিদেশে উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল। ১৯৮১-তে প্যারিসে রিলিজ হয়ে ফরাসি দুনিয়াকে মুগ্ধ করেছিল ‘জলসাঘর’।জন রাসেল টেলর ‘জলসাঘর’কে বলেছেন হিপনোটিক, জাদুকরী। ডেরেক ম্যালকম বলেছেন সত্যজিতের ‘মোস্ট পারফেক্ট ফিল্ম’। অবশ্য জলসাঘরকে মানুষের মনে বাস্তবিকভাবে তুলে ধরেছিলেন ছবি বিশ্বাস তার অসামান্য অভিনয় দিয়ে। এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন— ছবিবাবু চলে যাবার আগে বুঝতে পারিনি বাংলা ছবি তাঁর উপর কতটা বিপজ্জনকভাবে নির্ভরশীল ছিল। কোনও গল্প, উপন্যাস পড়তে গিয়ে আজ যদি কোনও জাঁদরেল চরিত্রের কথা পড়ি, বা কেতাদুরস্ত ভারভার্তিক বাঙালি বা ইঙ্গ-বঙ্গ চরিত্রের সামনে পড়ি, তবে আক্ষেপের সঙ্গে বলতে হয় এ চরিত্র মূর্ত করার মতো আর কেউ নেই। ইংরেজিতে যাকে বলে মনুমেন্টাল, এমন একজন অভিনেতাও নেই, যাঁকে দিয়ে এমন কোনও চরিত্রে রূপ দেওয়ানো যেতে পারে। জলসাঘরে বিশ্বম্ভর রায়ের চরিত্রে ছবি বিশ্বাস ছাড়া আর কোনও অভিনেতাকে কল্পনা করা সম্ভবই ছিল না। একদিকে বিশ্বম্ভর রায়ের দম্ভ ও অবিমৃস্যকারিতা, অন্য দিকে তাঁর পুত্রবাৎসল্য ও সংগীতপ্রিয়তা এবং সবশেষে তাঁর পতনের ট্র্যাজেডি― একসাথে সবগুলি চরিত্রের অভিব্যক্তি একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল।এদিকে সংগীত সম্পর্কে উনি একবারে উদাসীন। সারেগামাও জানেন না, রাগরাগিণী তো নয়ই। এই ছবিবাবুই কিন্তু ছবিতে ছেলের গানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এসরাজ বাজানোর দৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন। অক্লান্ত অধ্যবসায় করে এই কঠিন পরীক্ষাতেও দিব্যি উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
নিমতিতা জমিদারবাড়ির বিশালত্বে, আতিথেয়তায় সত্যজিৎ রায় মুগ্ধ হয়েছিলেন।এখানে তিনটি ছায়াছবি চিত্রায়িত হয়েছিল।জলসাঘর, দেবী ও তিনকন্যা ছায়াছবির শেষ খণ্ড সমাপ্তি।ভাবতেও অবাক লাগে কত প্রতিথযশা শিল্পীর পদধুলি পড়েছে এই বাড়িতে।গঙ্গাপদ বসু(জলসাঘর ছবিতে জমিদারের প্রতিবেশী মহিম গাঙ্গুলী), বেগম আখতার(দুর্গা বাঈ, গায়িকা), ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান(সানাই-বাদক),অপর্ণা সেন, সৌমিত্র চ্যাটার্জি ও শর্মিলা ঠাকুর।উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী,বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, অন্নদাশঙ্কর রায়, সাহিত্যিক লীলা মজুমদারও এই বাড়িতে এসেছিলেন।
অথচ আজ নাচমহলে ঝাড় বাতিটিও আর নেই, সারেঙ্গীর আওয়াজ শোনা যায় না, বাইজীদের পায়ের নূপুরও আর বাজে না, আতরের সুগন্ধিও আর নেই, রঙিন জলের ফোয়ারাও আর ওড়ে না।এখন শুধু শোনা যায় কিছু পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ।
চপলা সিংহের কাছ থেকে জানলাম শরিকী বিবাদের ফলে এবাড়ির এমন অবস্থা।অনেকে অনেক চেষ্টা করেছেন তবুও কোন পরিবর্তন হয়নি; হয়ত হবেও না।ঘুরতে ঘুরতে খেয়াল করিনি বেলা কত গড়িয়েছে।ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই লাফিয়ে উঠলাম।চপলা সিংহের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম।বাড়ির একপাশে একটি পুরানো আমলের ভাঙা-চোরা গাড়ি পড়ে থাকতে দেখলাম।সত্যজিৎ রায় নাকি এই গাড়ি চড়েছিলেন।এখন সবুজ লতা-পাতারা আষ্টেপৃষ্টে তাকে আপন করে নিয়েছে। আমার সারা গায়ে তখন শিহরণ।চোখে জল।মনে হচ্ছে এই সেই স্থান, এই সেই গাড়ি। এটাতে চড়েই সত্যজিৎ রায় একদিন এই নিমতিতা রাজবাড়ী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন।অতীতের সাথে বর্তমানের যোগসূত্র শুধু এটুকুই।ভাবতে পারি না।আনন্দ, দুঃখ আর এক অদ্ভুত ধরনের কষ্ট আমাকে কেমন যেন আচ্ছন্ন করে দেয়।১৯৫৮ সালে ‘জলসাঘর’ চলচ্চিত্রটি তৈরী হয়।আর আজকের সময়ে এসে সেই জলসাঘরের ভগ্ন চেহারা মনের মধ্যে এক বিরাট শূণ্যতার সৃষ্টি করে।
মনে পড়ে গেল জলসাঘরের গানের আসরে দুর্গাবাঈয়ের গাওয়া পিলু ঠুমরি। ‘ভরি ভরি আয়ি মোরি আঁখিয়া’। জলসাঘর চলচ্চিত্রের এক টুকরো সিকোয়েন্স।মহিম গাঙ্গুলির ইট বোঝাই লরির ধূলোর স্রোত আড়াল করে দিয়ে গেল এক সময়ের প্রতাপশালী জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের ঘোড়া বহরকে।যে ঘোড়া এক সময় দুর্দান্ত গতিতে ছুটটো ,দাপিয়ে বেড়াতো।বাস্তবেও তাই।প্রগতিশীল বাংলার নাট্যচর্চার অন্যতম কেন্দ্র আজ লোকচক্ষুর অন্তরালে, মফস্বলের শেষ প্রান্তে অন্তিম নিঃশ্বাস নিচ্ছে।মহিম গাঙ্গুলীর কথায় “মরা হাতি লাখ টাকা”।কতো সঙ্গীতের মূর্ছনা লেগে রয়েছে ঐ ভগ্ন দেওয়ালের গায়ে।বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিদের কথোপকথনের সাক্ষী একমাত্র এই জলসাঘর ! ধন্য হয়েছে সেই সব ব্যাক্তিবগের পদধূলিতে।নামহীন অসংখ্য শিল্পীরা একসময় যে সুর-মাধুর্য্য রচনা করে গিয়েছেন এখানে, তার রেশ হয়ত রয়ে যাবে অনাদিকাল।ইতিহাসের পাতা যেভাবে জীর্ণ হয়ে যায় ঠিক সেভাবেই কালের গর্ভে চলে যেতে বসেছে নিমতিতা রাজবাড়ি।জলসাঘরের শেষ পর্বে বিশ্বম্ভর রায়ের জমিদারি যেমন ধীরে ধীরে ভেঙে পড়েছিল, সেই ভাবেই মুছে যাচ্ছে এই রাজবাড়ির চাকচিক্যও।নাটকের আঁতুড় ঘর এই জমিদারবাড়ি হয়ত সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাবে একদিন। রেখে যাবে শুধু কিছু অমর স্মৃতি।
তথ্যসুত্র:
১. বংশ-পরিচয়(দ্বিতীয় খণ্ড)-জ্ঞানেন্দ্রনাথ কুমার
২. নিমতিতায় সত্যজিৎ- রবীন্দ্র নারায়ন চৌধুরী
"উত্তরবঙ্গ সংবাদপত্রের – উত্তর পর্ব" পাতায় আমার "ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে" লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে।
Plz don't copy my post ; share as much as you can...
লেখক:: সৌমেন জানা
NIMTITA RAJBARI, nimtita rajbari owner, nimtita rajbari history, nimtita rajbari durga puja, nimtita murshidabad, jalsaghar rajbari,
Darun bondhu
ReplyDelete