Thursday, September 22, 2022

মুর্শিদাবাদের পুজোর বনেদিয়ানা ও ঐতিহ্য || বালিঘাটা আদি বারোয়ারি দুর্গাপুজো

  বালিঘাটা আদি বারোয়ারি দুর্গাপুজো ||

 বালিঘাটা,রঘুনাথগঞ্জ,মুর্শিদাবাদ ||


∆ প্রায় ৪০০ বছর পূর্বে  অবিভক্ত ভারতের বাংলা প্রদেশে নিজ ভাগ্য অন্নেষণে এসেছিলেন শ্রী হরিনারায়ণ মিশ্র। নিষ্ঠাবান শাক্ত বংশীয় ব্রাহ্মণ হরিনারায়ণ সাথে এনেছিলেন অষ্টধাতুর কুলদেবী বিগ্রহ শ্রী শ্রী সিংহবাহিনী। 

বালিঘাটাতে সেই সময় ছিল নাটোর রাজবাড়ির কাছারি। সেই কাছারি ঘরে হরিনারায়ণ কর্ম সংস্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। হরিনারায়ণের পুত্র শ্রী কালীপ্রসন্ন মিশ্র যুবা বয়সে পিতার কর্মভার গ্রহণ করলে, হরিনারায়ণ সস্ত্রীক পুনরায় মিথিলা ফিরে যান । 

হরিনারায়ণ এর পর কালিপ্রসন্নের তত্ত্বাবধানে শ্রী শ্রী সিংহবাহিনী পুজা চলতে থাকে।

কালক্রমে, কালীপ্রসন্নর পুত্র শ্রী অনন্ত লাল মিশ্রর হাতে পুজার দায়িত্ব পরে। কিন্তু অনন্তলালের ব্যবহারিক তথা চারিত্রিক দিক ঠিক ছিল না । পুত্রের জীবন যাত্রায় বিব্রত বোধ করে কালীপ্রসন্ন সস্ত্রীক মিথিলাতে ফিরে যান | এবার শুধু সস্ত্রীক নয় কুলদেবীর অষ্টধাতুর বিগ্রহটিও নিয়ে চলে যান মিথিলাতে।

ততদিনে বালিঘাটা বাসীর হৃদয়ে সিংহবাহিনীর জন্য আলাদা স্থান হয়ে গেছে। সিংহবাহিনীর অবর্তমানে বালিঘাটাবাসী অনন্তলাল মিশ্রের কাছে সিংহবাহিনীর বেদিতে মৃন্ময়ী প্রতিমা পুজা প্রতিষ্ঠার আবেদন জানায় 

সেই মতো তিন বছর অনন্তলাল মৃন্ময়ী পুজা চালান। এই সময় পুজার সংকল্প হতো শ্রী রামচন্দ্রের নামে।  

পরবর্তীতে তাঁর আর্থিক অবস্থার অবনতির ফলে তিনি এখানকার বাড়ি,পুকুর,স্থাবর সম্পত্তি সব দান ও বিক্রি করে দিয়ে মিথিলাতে চলে যান । কিন্তু দুর্গাপুজার কোনো ব্যবস্থা করে উনি যেতে পারেননি । 

সেই সময় জনৈক রজনীকান্ত ঘোষ নিজ তত্ত্বাবধানে ও বালিঘাটা বাসীর সহায়তায় তিন বছর পুজা চালান, তাঁর পরবর্তী থেকে এই পুজা সম্পূর্ণ বারোয়ারি পুজার রূপ পায় প্রায় ৩০০ বছর পূর্বে । 

প্রাচীন জীর্ণ ভগ্নপ্রায় মন্দিরের পুনরুদ্ধার হয় ২০১৫ সালে । আশ্চর্যের বিষয় ৪৪ফুট উচ্চতার চূড়া বিশিষ্ট সুবিশাল এই মন্দির শুধু ভিক্ষা নির্ভরতায় নির্মিত হয়েছে এবং এত সুবিশাল মন্দির মাত্র ৮মাসের মধ্যেই সম্পূর্ণ হয়েছে । মায়ের কৃপা ছাড়া তা সম্ভব নয়। (নব্য মন্দির প্রতিষ্ঠা দিবস - ২৬ সেপ্টেম্বর,২০১৫) | মা এখানে শ্রী শ্রী ভোটেশ্বরী নামে বিখ্যাত | বর্তমানে পুজোয় নবীনকরণ হলেও ঐতিহ্য বজায় রয়েছে এবং প্রত্যেক বছর শিল্পী শ্রী বিশ্বরূপ পালের হাতে ডাকের সাজে সেজে ওঠেন মা |

এছাড়া প্রতিবছর পুত্র প্রাপ্তি, রোগ নিরাময় প্রভৃতির জন্য বহু মানুষ মানসিক করেন । মা সব পূর্ণ করেন । 

আদি বারোয়ারির এই পুজোয় বলিদান নীতি পালিত হয়।  কিন্তু আদি বারোয়ারির পুজোয় সপ্তমী,সন্ধি,নবমীতে ছাগ বলি, মেষ বলি, আখ বলি,কুমড়ো বলি ও কলা বলি দেওয়া হয় । মায়ের অন্নের ভোগ হয়না । লুচির ভোগ এখানকার রীতি। 

মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যায় আমন্ত্রণ ও অধিবাস ক্রিয়ার পর মহাসপ্তমীর শারদ প্রভাতে নবপত্রিকা স্নানের শোভাযাত্রা অন্যতম। একাদশীর সন্ধ্যাতে মায়ের বিসর্জন শোভাযাত্রা তে প্রচুর লোক সমাগম হয় । হাজার হাজার ভক্তের ভিড়ে "আসছে বছর আবার হবে" ধ্বনি তে সৃষ্টি হয় রঘুনাথগঞ্জের সবচেয়ে বড়ো দুর্গা বিসর্জন শোভাযাত্রা। প্রাচীন ঐতিহ্য, ভক্তি, উৎসব এর সংমিশ্রণে বালিঘাটা আদি বারোয়ারি দুর্গাপুজা সত্যই রঘুনাথগঞ্জের পুজা ইতিহাসের ধ্রুব তারা।

প্রতিবছর একাদশীর দুপুরে এই মন্দিরে শ্রী শ্রী ভগবতীর সামনে মা পেটকাটির ঘট রেখে বিশেষ পুজো হয় । জনশ্রুতি মা পেটকাটি ও ভগবতী দুই বোন, পুর্বে দশমীর রাতে দুজনের একসাথে বাহিচ হত। তবে বর্তমানে পরিস্থিতির কারণে তা আর হয়না।

Wednesday, September 21, 2022

চক্রবর্তীদের জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো / বৈদরাজমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো

               চক্রবর্তীদের জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো /বৈদরাজমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো


রঘুনাথগঞ্জ ব্লকের বৈদরা গ্রামে প্রায় 450 বছরের প্রাচীন চক্রবর্তীদের জমিদার বাড়ির এই দুর্গাপুজো। যেখানে শুধু এই হিন্দু পরিবার নয়, গ্রামের হিন্দু-মুসলিম সবাই একত্র হয়ে পুজোয় অংশগ্রহণ করেন।

সাম্প্রদায়িক হিংসা আর হানাহানি যখন দেশ জুড়ে বার বার আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি করছে, তখন ভিন্ন ছবি মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জে। সম্প্রীতির দুর্গাপুজো।

প্রায় 450 বছর আগে এই পুজো প্রথম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তৎকালীন জমিদার। এখনও প্রতি বার আগের মতোই পুজো শুরু হয় গ্রামের দুধসাগর পুকুরের জল ঘটে ভরে বোধনের মধ্য দিয়ে। ষষ্ঠী পর্যন্ত চলে দৈনিক চণ্ডীপাঠ।

এই গ্রামে এক সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজন বসবাস করেন। দুর্গাপুজোর কাজেও অংশ নেন গ্রামের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা। প্রতিমা তৈরি থেকে পুজো দেখা, আরতি— হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পুজোর চার দিন হাজির থাকেন। বিসর্জনের শোভাযাত্রাতেও অংশ নেন মুসলমানরা। প্রতিমা নিয়ে যেতে কাঁধও লাগান।

বিজয়ার শুভেচ্ছা জানাতে গ্রামের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজন প্রতি বারই জমিদার বাড়িতে আসেন। জমিদার বাড়ির পক্ষ থেকেও গ্রামের সব মুসলমান পরিবারে লুচি ও ফল পাঠানো হয়। পরিবারের বর্তমান সদস্যরা কর্মসূত্রে বাইরে থাকলেও পুজোর সময়ে সবাই একত্রিত হন।

Thursday, September 8, 2022

কৈলঠা বাড়ির পুজো

              সেভাবে কোনোদিনই প্রচারের আলোয় না আসলেও বরাবরের মতো এবারেও এলাকার মানুষের আবেগ নিয়ে 222 তম বছরে পূজিত হচ্ছেন দেবী। হ্যাঁ ,কৈলঠা বাড়ির পুজো। মুর্শিদাবাদের এই এলাকা বরাবরের জন্য গরদ সিল্কের জন্য প্রসিদ্ধ। শুনেছি পারিবারিক সিল্কের ব্যবসায় একসময় সমৃদ্ধ ছিল পরিবারটি। বৃটিশদের সাথে কোনো এক মামলায় জয়ী হওয়ায় পুজো শুরু হয়। পাড়ার বয়স্কদের কাছে শুনেছি আগে মাটির এবং বাঁশের ঘরে পুজো হত। পরবর্তীতে প্রায় একশো বছর আগে এই মন্দির টি নির্মিত হয়।  যে কটি পুরোনো বস্তু থেকে সময় ধরা হয় সেগুলি বর্তমানে ব্যবহৃত না হলেও যত্ন করে সংরক্ষিত আছে। আর অন্যান্য প্রাচীন পুজোর মতই নানা গল্পকথা এই পুজোর সাথেও  জড়িত আছে। পুরোনো মানুষ জন এবং পুজোর সঙ্গে জড়িত অনেকেই আর সেই সব কাজের সাথে যুক্ত নেই । তবুও সেই ঐতিহ্য ও ঘরাণা আজও লালিত হচ্ছে মর্যাদার সাথে। শিল্পিও নানান সময় বদলেছে, কিন্তু প্যাটার্নটা অদ্ভূত ভাবে মিলে যায়।   কুড়ি বছরের নানান ছবি সেটার সাক্ষী।                                  

                          সেভাবে কখনোই কোনো উৎসবে না মাতলেও এই কটা দিন নানান দায়িত্ব সামলাতে ও পরিবার পরিজন ও এলাকার মানুষজনের সাথে একাত্ম হতে বেশ লাগে। 

                             আমার সকল বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানালাম , পুজোতে প্রতিমা দেখার পাশাপাশি আমাকে তোমাদের আনন্দের অংশীদার হওয়ার সুযোগ দিতে। তথাকথিত "কাগুজে" বনেদিয়ানা নাই বা থাকল , মানুষের আবেগের ভীতটা তো আছে!



আমি  এধরনের পোস্ট করতে অভ্যস্ত নই। বিশেষ করে পুজো পার্বনে বা কোনো অনুষ্ঠানে। তবু পারিবারিক পুজো উপলক্ষে কিছু কথা ,ভাবনা যেভাবে মনকে পীড়া দেয় তা ভাগ করে দিতেই একটু চেষ্টা। আসলে কোনো উৎসব অনুষ্ঠানে যাঁরা না থাকলে উৎসবের কোনো আঁচই মনে আসে না তাঁদের কথা বার বার মনকে নাড়া দেয়। 

              যেটা বলতে চাইছিলাম, আমি আমার বাড়ির পুজোকে বনেদি বাড়ির পুজো বলব এতটা আঁতেল আমি নই। কিন্তু একে ঘিরে যে স্মৃতি আমার মনে থেকে গেছে তা রীতিমতো বিষ্ময়ের।আগেই বলেছি পুজোটা দুশো বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে । ফলে জন্মঅবধি দেখেছি কাকু জেঠু বাবারা একসাথেই পুজো করছেন । পুজোর সঙ্গে যুক্ত নানান মানুষ জন আশেপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসতেন। এমনি একজন মানুষ কে দেখেছি আমার আট দশ বছর বয়স থেকে পুজো করতে আসতেন । শুনেছি তাঁর পিতাও আসতেন এই বাড়িতে। "বৃন্দাবন ভট্টাচার্য" মুর্শিদাবাদ বাদ জেলার তাঁতিবিড়োল গ্রামের একজন বড় জমিদার শ্রেনির মানুষ , আদতে দীর্ঘদেহী সুপুরুষ যিনি আমাদের সবার "ঠাকুর দাদু "। আমার এসব কথা পড়লে বন্ধুবান্ধবেরা সবাই কিভাবে নেবে জানিনা,কারন তাদের চোখে আমি নাকি কিছুটা নাস্তিক গোছের । অনেকে আমাকে রাগ করে জড়বাদী বলত একসময়। কিন্তু তাই বলে পুরোনো ইতিহাস, আবেগ ,জনশ্রুতি তাকে এড়াব কি করে? যেকথা বলছিলাম ,বৃন্দাবন দাদুর পুজোর মন্ত্রোচ্চারণ , কন্ঠস্বর যে কোনো নারী, বিশেষ করে যাঁরা পুজো দিতে আসছেন তাদের হৃদয়ে তো দাগ কাটতোই , বড় বিচক্ষণ মানুষেরাও বাদ যেতোনা। তাঁর আরতির মাঝে নৃত্য , সন্ধিপুজোর মাঝে অমিতাভ বচ্চনের আওয়াজে বিরেন্দ্রকৃষ্ণ এফেক্টের চন্ডীপাঠ আমার কিশোর মনেও রেখাপাত করেছিল। এক অদ্ভুত মানুষ ছিলেন বৃন্দাবন দাদু,চল্লিশ  বছর আগে দক্ষিণা পেতেন নামমাত্র কিন্তু প্রতিবারই পরের বার আসবনা বলা সত্বেও ঠিক সময়ে গরুর গাড়ি চড়ে চলে আসতেন। কটাদিন পাড়া মাতিয়ে দশমীর দিন সবাই কে কাঁদিয়ে বিদায় নিতেন। যত বড় হয়েছি দাদুর প্রতি আকর্ষণ তত বেড়ে গেছে। আগেই বলেছি বনেদি পুজো না বলেও একটি প্রাচীন সাবেকি পুজোর তকমা দেওয়াই যায়। দীর্ঘ সময় পরিবারের সবাই মিলে একসাথে পুজো করলেও একটা সময় সেটাও ধাক্কা খেল। এখানেই টুইস্ট। আসলে 'পুরোহিত' দাদু যখন আমাদের পুজোতে আসতেন তখন পাঁচটা দিন আমার একশো কুড়ি বছরের ঘর থেকে আমাদের বের করে দিতেন । আমরা অর্থাৎ আমি আর ঠাকুমা। বরাবরই দোতলা বাড়িটার একতলার ঘরে থাকতাম। প্রসঙ্গত আজও সেখানেই আছি। কিন্তু দেখতাম ষষ্ঠীর দিন দাদু এসে খাট দখল করে নিতেন । আর আমি এবং ঠাকুমা পুজোর ঐ কটা দিন কাটাতাম  দক্ষিণ দিকের মাটির ঘরটায়। খুব রাগ হতো তখন। ব্যাপারটা আরো মাত্রা পেত যখন দেখতাম অন্য শরিকের বেলাতেও দাদু স্বস্থানে। কিন্তু অবাক লাগত জোরটা দাদু কোথা থেকে পেতেন! পরবর্তীতে পুজোর ভার পাইকর হয়ে রামপুরহাট চলে গেছে কিন্তু ঘর থেকে বের করে দেবার মতো জোরটা খুব মিস করি। সেই দিন গুলো আর কোনোদিন ফিরে আসবে না ঠিকই কিন্তু গল্পগুলো নতুন প্রজন্ম জানলে আত্মকেন্দ্রিকতার সময়ে কিছুটা হলেও ইনস্পিরেশন পাবে।



আজকে একটু আলাদা বিষয়ে বলি। দূর্গাপুজোর যে সকল সামগ্রী লাগে তা  যোগাড় করা এখন অনেক সহজ  বলে মনে হয়। কিন্তু একটা সময় দেখেছি কোথাও সমুদ্র দেখতে যাচ্ছি শুনলেই ঠাকুমা শিশি ধরিয়ে দিতেন জল আনার জন্য। পরে কখনো দেখতাম বোতলে করে বৃষ্টির জল ধরছেন। অনেক সময় আদিক্ষেতা মনে হলেও পরে বুঝতাম আন্তরিকতা কতখানি ,না হলে একটা একটা করে শিউলি ফুলের বোঁটা ছিঁড়ে কেউ রঙ তৈরী করতে পারে! (যেটা 'অষ্টদল পত্র' তৈরীতে লাগে) এই কটা দিন গোটা পরিবারের মহিলারা যে অমানুষিক পরিশ্রম করেন তা বলবার নয়। নইলে পরিবারের আধুনিকারা, তা সে বাড়ির মেয়েই হোক বা বৌমা কাউকে এই কটা দিন সেভাবে মাঞ্জা দিতে দেখিনা। অবশ্য শেষ বেলায় বিজয়ার আগে তারা যে সেরাটা দেবেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। তো যে কথাটা বলছিলাম বাড়ির কথা তো বললাম কিন্তু জন্মঅবধি যাকে দেখছি, যার বয়স বাড়েনা, সেই সুশীলকাকু" ফুল বেলপাতা অশোক ছাতিম যাবতীয় চাহিদার একমাত্র ভরসা পুজো পরিচালনার সিংহভাগ ভার অবলীলায় সামলে দেন। আসেন আট কিলোমিটার দুরের গ্রাম থেকে। আসলে একটা উৎসব যখন এত এত মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয় তখনই শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে। এই পুজোয় নানান রেওয়াজ আছে তার বেশিরভাগ কারনই খুঁজে বের করেছি । যেমন , কলাবৌ এর বিভিন্ন উদ্ভিদ এর সাথে ব্যবহৃত একটি দন্ড। যা অন্য কোথাও দেখি না। কিন্তু এখানে এটা ব্যবহারের কারন গরদ শিল্পের সঙ্গে দন্ডটির যোগ। সেটি আবার আসে প্রতিবেশির বাড়ি থেকে। কিন্তু কলাবৌ যেখানে গনেশের দিকে থাকে এক্ষেত্রে সেটি জন্মঅবধি দেখছি কার্তিকের দিকে! আজও বুঝিনি।

                          ও হ্যাঁ এই কদিন লেখাগুলো লিখছি এক ভাই এর অনুরোধে । কোনো মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য নয়।       

                      তাই কেউ যেন "ডিজিট্যাল ঈর্ষার" শিকার না হন। আপনারা নিচ্ছেন বলেই লিখতে আগ্রহ পাচ্ছি।

কৈলঠা বাড়ির দূর্গাপুজো পুজো কি কখনো কারো হয়? আয়োজক মাত্র। আসলে উৎসবের শ্রেষ্ঠত্ব সেখানেই যখন বহু মানুষের ইনভলভমেন্ট উৎসবের সাথে যোগ হয়ে যায়। যে এলাকায় এই পুজো টি হচ্ছে সেটি মুলত একটি গ্রাম। কিন্তু সাংস্কৃতিক চেতনায় যে "স্টেটাস" বহন করে তাতে যে কোনো নিন্দুকের 'বাক বন্দি' হয়ে যেতে পারে। ও হ্যাঁ এ প্রসঙ্গে বলি একজন  অধ্যাপক মহাশয়ের পদবী সংক্রান্ত  একটি গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে জানা যায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বিভিন্ন পদবীর সাথে নানান সংস্কৃতিরও মেলবন্ধন এখানে ঘটেছে। ফলতঃ বহুদিন যাবৎ এই পুজোটির সাক্ষী হয়ে মানুষজন পুজোটির সাথে একাত্ব হয়ে গেছেন। তিন কিলোমিটার দুর থেকে মঙ্গলঘট নিয়ে গ্রামের ভিতরে প্রবেশ করার সময় নারীপুরুষ নির্বিশেষে ধূপধুনো নিয়ে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে স্বাগত জানানোর দৃশ্য যে কোনো চিত্রপরিচালকের মেটিরিয়াল হয়ে যাবে। 

                                        কদিন আগে এই পুজোটি সংক্রান্ত লেখায় একজন বলছিলেন এই পুজোটি যেন এলাকার GMT। বাস্তবিকই তাই। আর হবে নাই বা কেন। সময়, নির্ঘন্ট, নিয়ম,উপাচার এসব  যত্ন করে খেয়াল রাখাও যে আয়োজকদের দায়িত্ব। ভাবা যায় এই গ্রামের কয়েকটা এলাকার মানুষ রাত্রে দেবীর নীরঞ্জন না হওয়া পর্যন্ত অন্ন পর্যন্ত গ্রহণ করেন না। যাকে বলে "সেফ ডিপারচার"। সেই খবর নেবার পর অন্নগ্রহণ। আমি তো রীতিমতো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি ব্যাপারটা শুনে।

                               "মির্জাপুর" এলাকাটি অত্যন্ত আকর্ষণের জায়গা। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও যথেষ্ট। ছোটবেলার থেকে দেখেছি বাজি পোড়ানোর হিড়িক। রীতিমতো প্রতিযোগিতা হতেও দেখেছি। বিষাদের বিজয়াতেও যথেষ্ট উন্মাদনা থাকে সব জায়গার মতোই। বিজয়ার সময়  একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল। যা এই প্রজন্মের কাছে এরকম আত্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে চ্যালেঞ্জের। সেবার বিসর্জনের সময় প্রতিমা বেদি থেকে নামানোর পর বরণ পর্ব শেষ করে গয়না খুলে "বেহারা"র কাঁধে চড়ে সবে বাড়ির চৌহদ্দি পেরিয়েছে , হঠাৎ দেখি প্রতিমার হাতগুলো শুধু কাঠামোর সাথে লেগে আছে, বাকি সম্পূর্ণ দেহ মাটিতে। ব্যাস,খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। বাড়ির মহিলারা তো আছেনই গ্রামের সমস্ত মানুষ সেদিন বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে ছিলেন। কিন্তু তাতে অবাক হইনি, অবাক হয়েছিলাম সেই আবেগ দেখে যার জন্য  দীঘির ঘাট পর্যন্ত সম্পূর্ণ রাস্তায় আর একটি বাজিও সেদিন কেউ ফাটায়নি। সম্পূর্ণ রাস্তায় শ্মশানের নিস্তব্ধতা।

                                    মাঝবয়সের একটি স্মৃতি মনকে খুবই নাড়া দিত । কিছুটা অবাকও হতাম। প্রতিমা নিয়ে যখন ঘাটে পৌঁছতাম , দেখতাম গ্রামের অন্য প্রতিমা নিয়ে অন্য পাড়ার মানুষেরা অপেক্ষা করছেন। আবার মাঝপথে চৌধুরী বাড়ির দেবী চৌধুরী বাড়ির কাছে "বড় ভগবতী" পৌছানোর সাথে সাথেই  সঙ্গ নিত। কি যে মজা পেতাম সেদিন। গান গাইতে গাইতে প্রতিমা বাহকেরা কিছুটা এগোনোর পর হঠাৎ থেমে গিয়ে পিছিয়ে আসবার পর দেখতাম অত বড় প্রতিমা নিয়ে দৌড়চ্ছে। সে এক মজার ব্যাপার। কারনটা সেদিন না বুঝলেও অনেক পড়ে উদ্ধার করেছিলাম।

                        একটা কথা বলতেই হয়, বিগত কয়েক দশকে আর্থসামাজিক পরিস্থিতির বিস্তর পরিবর্তন হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই যারা প্রতিমা বহন করেন তাদের অনেকেরই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু তাদের কে স্যালুট জানাতেই হবে কারণ চল্লিশ বছর আগেও শুনেছি তাদের পূর্বপুরুষেরা ও এই কাজ করে এসেছেন আজও তারাও মেনে চলছেন।  ও এঁরা হলেন পাশের একটি গ্রাম "দক্ষিণপাড়ার" বাসিন্দা।আজ পর্যন্ত এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।  পূর্বপুরুষদের প্রতি সম্মান জানানোর এই রেওয়াজ প্রশংসার যোগ্য।  পারিশ্রমিক দিয়ে এর মূল্যায়ন করা যাবে না।  এই পুজোর সাথে জড়িত বিভিন্ন রেওয়াজ এলাকার মানুষের সাহায্য নিয়ে আজও পালিত হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু কৃষ্টি, সংস্কৃতি , রেওয়াজের ঐতিহ্য সবার আন্তরিকতাতেই রক্ষিত হয়। নতূন প্রজন্মের কাছে তা হয়তো উদাহরণ হয়ে থাকবে!       

           সবাই ভালো থাকো।   

Tuesday, August 23, 2022

মা মৌলীক্ষার মন্দিরের ইতিহাস/বীরভূম লাগোয়া ঝাড়খন্ডের মলুটির মা মৌলীক্ষা

 তারাপীঠের মা তারার বড়ো বোন হন বীরভূম লাগোয়া ঝাড়খন্ডের মলুটির মা মৌলীক্ষা। মহুল গাছে ঘেরা মলুটি গ্রাম, ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলার দুমকা মহকুমার শিকারীপাড়া সিডি ব্লকের একটি ছোট্ট সুন্দর নিরিবিলি গ্রাম। এটি পূর্বে বাঁকুড়ার মল্ল রাজাদের অধীনে ছিল, নাম ছিল মল্লহাটি; অতঃপর হয়ে ওঠে মুলুটি। সেই সময়ে মল্ল রাজাদের দ্বারা শাসিত এই অঞ্চলটির বিস্তার ছিল উত্তরে বর্তমান পাকুড়, পূর্বে বর্ধমান, দক্ষিণে মেদিনীপুর এবং পশ্চিমে ছোট নাগপুর মালভূমির কিছু অংশ নিয়ে, এই অঞ্চলকে মল্লভূমও বলা হত। রামপুরহাট থেকে এই গ্রামের দূরত্ব মাত্র ১২ কিমি, দুমকা এখান থেকে ৫৫ কিমি দূরে।


চতুর্দশ শতকের মল্ল রাজাদের ঘাঁটি, মল্লহাটি আজ মলুটি নামে পরিচিত, এই মল্ল রাজারা ছিল বিষ্ণুপুরের শাসনকর্তা। গ্রামের ধার দিয়ে চুমড়ে আর চন্দননালা বয়ে চলেছে। এখানে বাঙালির সংখ্যা বেশি হলেও এখানে আদিবাসী বসতি দেখতে পাওয়া যায়, বিশেষ করে ওঁরাও উপজাতি। তারপর সুলতানী যুগে এই সকল অঞ্চল মুসলিম শাসকদের অধিকারে চলে যায়। সপ্তদশ শতকে ঘটে যায় অভূতপূর্ব এক ঘটনা, যার ফলে মলুটি এক সাধারণ বঙ্গ সন্তানের শাসনাধীন হয়ে ওঠে। আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে বসন্ত রায় বলে এক গরীব ব্রাহ্মণ বাস করতেন বীরভূম জেলার ময়ূরেশ্বরের কাছাকাছি কাটিগ্রামে। পিতৃহারা বসন্ত লোকের গরু-বাছুর চরিয়ে দিন কাটাতেন। একদিন মাঠে গরু চরাতে গিয়ে বালক বসন্ত গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এদিকে বেলা যত বাড়তে থাকে,  বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের আলো এসে তার মুখে পড়ে, একটি বিষধর সাপ হঠাৎ কোথা থেকে এসে বালকের মুখে রোদ পড়তে দেখে, তার ফনা তুলে  বালকটিকে আড়াল করে;  সেইসময় ঐ পথে কাশীর সুমেরু মঠের মোহান্ত দণ্ডীস্বামী নিগমানন্দ মহারাজ যাচ্ছিলেন। তিনি এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে বালকটির কাছে এগিয়ে যেতে, সাপটি তৎক্ষণাৎ পালিয়ে যায়। বালকটিকে ডেকে, তাকে নিয়ে তার মায়ের কাছে বলেন, যে তার ছেলের রাজযোগ রয়েছে, খুব শীঘ্রই তার ছেলে বসন্ত রাজা হবে।

 নিগমানন্দ মহারাজের সেই ভবিষ্যত বাণী বিফলে যায়নি। 


এই ঘটনার কিছুদিন পর, গৌড়ের বাদশা আলাউদ্দিন হোসেন শাহ উৎকল দেশ জয় করে ফেরার পথে কাটিগ্রাম থেকে কিছু দূরে ময়ূরাক্ষীর ধারে তাঁবু ফেলেছিলেন। হঠাৎ একদিন তাঁর বেগমের প্রিয় পোষ্য বাজপাখি সোনার শিকল কেটে পালিয়ে যায়। পাখির শোক বেগম সাহেবা কিছুতে ভুলতে পারছিলেন না, তাই সম্রাট ঘোষণা করেন, যে ব্যক্তি ঐ পাখিটি ধরে এনে দেবে, তাকে তার ইচ্ছে অনুযায়ী যা চাইবে, তাই দেবেন।  এদিকে সেই বাজ পাখিকে বন্দী করলো বসন্ত, সে পাখিটির জন্য  ফাঁদ পেতেছিল। পাখিকে নিয়ে বসন্ত, বাদশার কাছে গেল, বাদশা খুশি হয়ে বসন্তকে  পরদিন সূর্যোদয় থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ঘোড়ায় চেপে গ্রামে ঘুরতে বললেন।  যতটা সে ঘুরতে পারবে, ততটাই জমি সে পাবে 'নানকার' অর্থাৎ করহীন জমিদারি রূপে। এইভাবেই বসন্ত হলেন অধুনা ঝাড়খণ্ডের নানকার রাজ্যের রাজা এবং বাজপাখি ধরে দেওয়ার জন্য তার নাম হলো 'বাজ বসন্ত'।


এই বসন্ত রায়ের পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম মলুটিতে তাঁদের রাজধানী স্থাপন করেন। এই বংশের সকল রাজা ছিলেন শিবের ভক্ত। তারা প্রায় প্রত্যেকেই এখানে শিবের জন্য দেউল বা মন্দির গড়ে তোলেন বছরের পর বছর ধরে। দীর্ঘ একশো বছর ধরে,নানকার গড়ে ওঠে অসাধারণ টেরাকোটা স্থাপত্যের ১০৮টি শিব মন্দির। তবে, এই মন্দিরগুলি  এক সাথে নয়, পুরো গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।  কালের প্রবাহে, বর্তমানে এই ১০৮টির মধ্যে ৭২টি আজ অক্ষত রয়েছে, বাকি সব ধ্বংস হয়ে গেছে। এই ৭২টির ভেতর ৫৭টি চারচালা ঘরানার। বাকিগুলি রেখ দেউল, রাসমঞ্চ, সমতল ছাদ কিংবা একবাংলা। মন্দিরগুলির ভগ্ন দশার মধ্যেও এখনো কিছু কিছু  অপরূপ টেরাকোটার কার্যের শিল্পসুষমা বিদ্যমান। কোথাও মহিষাসুরমর্দিনীর চিত্র, কোথাও রামায়ণ, কোথাও রাম রাবণের যুদ্ধ, কোথাও মহাভারতের বিভিন্ন চিত্র, শিব দুর্গা, বিষ্ণু মূর্তি,  ফুল-লতা-পাতার টেরাকোটার মোটিভগুলি নজর কেড়ে নেয়। মন্দিরগুলির দরজার খিলানের উপর অংশে সংস্কৃত ভাষায় মন্দিরের প্রতিষ্ঠালিপি খোদিত রয়েছে। ইউনেস্কো মলুটিকে হেরিটেজ ভিলেজ আখ্যা দিয়েছে, কিন্তু সঠিক সংরক্ষণের অভাবে আজ মন্দিরগুলির বহুমূল্যবান প্রাচীন টেরাকোটার শিল্পকর্মগুলি ধ্বংসের পথে। মন্দিরগুলোতে দেবতা শিব থাকলেও, মাত্র কয়েকটা মন্দিরে পূজা হয়,বাকি ভগ্নপ্রায় হয়ে পড়ে রয়েছে। 


মলুটির প্রধান আকর্ষণ মা মৌলীক্ষার মন্দির। ১৮৫৭ সালে, মহাসাধক বামদেব এখানে একজন পুরোহিত হতে আসেন কিন্তু তিনি সংস্কৃত মন্ত্রগুলি মুখস্থ করতে পারেননি বলে ব্যর্থ হন। তাকে এখানকার একটি বিষ্ণু মন্দিরে পুজোর ফুল জোগাড় করার ও ভোগ রান্না করার চাকরি দেওয়া হয়। এখানে তিনি ১৮ মাস থেকে ছিলেন, তিনি এখানে থাকার বেশিরভাগ সময় মৌলীক্ষা মন্দিরে কাটাতেন। এখানেই তিনি প্রথম সিদ্ধিলাভ করেন, তারপর তারাপীঠের শশ্মানে সিদ্ধি লাভ করেন। তাঁর ব্যবহৃত ত্রিশূল, শঙ্খ এখনও মলুটিতে সংরক্ষিত আছে। তিনি মলুটির দেবী মৌলীক্ষাকে বড় মা ও তারাপীঠের তারামাকে ছোট মা বলতেন।  সেই থেকেই দেবী মৌলীক্ষাকে সবাই বড় মা বলে থাকেন।


মৌলীক্ষা: গ্রামের দক্ষিণ দিকে গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মা মৌলীক্ষার মন্দির। ‘মৌলি' শব্দের অর্থ মস্তক আর ‘ইক্ষা' শব্দের অর্থ দৃশ্যমান; অর্থাৎ, মৌলীক্ষা শব্দের অর্থ দৃশ্যমান মস্তক। মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবীর বিগ্রহ বলতে লাল ল্যাটেরাইট পাথরে খোদাই করা দেবীর মুখমণ্ডল শুধু দেখতে পাওয়া যায়, কোনো অবয়ব নেই। দেবীর ত্রিনয়ন রূপার তৈরী। মূর্তির গড়নে বজ্রযানী বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব সুস্পষ্ট। বৌদ্ধ তান্ত্রিক বজ্রযানীদের আরাধ্যা দেবী সিংহবাহিনী এখানে দেবী মৌলীক্ষা। মনে করা হয়, এই দেবী বজ্রযানী বৌদ্ধদের পূজিতা দেবী ছিলেন। কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রাচীন মন্দিরটি মাটির তলায় চাপা পড়ে যায়। পরবর্তীকালে, স্বপ্নাদেশ পেয়ে নানকার রাজা রাখরচন্দ্র, দেবী মৌলীক্ষার বিগ্রহ উদ্ধার করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই দেবী দুর্গারই একটি রূপ, দেবীর বাহনও সিংহ। দুর্গা মন্ত্রে দেবীর পূজা হয়।


আশ্বিনের শুক্লা চতুর্দশীতে বণিক জয়দত্তের তারামায়ের শিলা মূর্তি শ্মশানের শ্বেত শিমূল বৃক্ষের তলা থেকে উদ্ধার করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে ঐদিন তারা মায়ের মহাপুজা অনুষ্ঠিত হয় তারাপীঠে। একবার নানকার রাজা রাখড়চন্দ্র, ঐ বিশেষ দিনে, তারাপীঠে পুজো দিতে এসেছিলেন।সেইদিন প্রথামতো মন্দিরের নাট মন্দিরে মায়ের বিগ্রহকে এনে পূর্বমুখী করে বসিয়ে পূজা করছিলেন মন্দিরের পুরোহিতরা। কিন্তু তারাপীঠের মন্দিরে রাজাকে দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রাখেন নাটোরের রানীর কর্মচারীরা। রাজাকে পূজা দিতে বাঁধা দিয়ে তাঁকে একপ্রকার তাড়িয়ে দেন মন্দিরের কৌল সন্ন্যাসীরা।  তারা মায়ের পূজা দিতে না পেরে হতাশায় কাঁদতে কাঁদতে শেষপর্যন্ত  দ্বারকা নদীর ধারে ঘট প্রতিষ্ঠা করে দেবীর পুজো করেন তারা মায়ের পরম ভক্ত রাজা রাখড়চন্দ্র। তারপর এ কী কান্ড!!!  তারা মায়ের মন্দিরে পূজার সময় বিরামমঞ্চ থেকে তারা মায়ের মুখ আপনা থেকেই পশ্চিমমুখী হয়ে গেল, যেদিকে তাঁর ভক্ত রাজা পূজা করছিলেন ঠিক সেই পানে। সবাই আশ্চর্য হয়ে গেল এই ঘটনায়, জয় তারা জয় তারা বোলে চারদিক মুখরিত হলো। মা তাঁর ভক্তের পূজা ঘটেই নিলেন সেইদিন, মন্দিরে নয়। এদিকে সেইদিন নাটোরের রাণীকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে মা তারা বলেন, মন্দিরে তাঁর পুজো সম্পন্ন হয়নি। রাণী তখন মন্দিরের কর্মচারীদের নিকট ঝাড়খণ্ডের রাজার ঘটনাটি শোনেন। তৎক্ষণাৎ, রাণী ঝাড়খণ্ডের রাজার কাছে দূত পাঠিয়ে তারা মায়ের পূজা দিতে যাওয়ার অনুরোধ করেন।  রাজা এসে মা তারার পূজা করেন আনন্দ সহকারে। তারপর রাজাকে মা মৌলীক্ষা স্বপ্ন দিয়ে মলুটি গ্রামে তাঁর অবস্থানের কথা বলেন; রাজা মায়ের মন্দির স্থাপন করেন। পরে মা তারা, তারাপীঠের এক পুরোহিতকে স্বপ্নে নির্দেশ দেন, আশ্বিন শুক্লা চতুর্থীর দিন যেনো তাঁর বিগ্রহকে পশ্চিমমুখো করে বসানো হয়। আজও সেই নির্দেশ মেনে চলা হয় এবং ঐদিন মলুটি গ্রামে দেবী মৌলীক্ষার পুজো শেষে তারা পীঠে মা তারার পূজা শুরু হয়। কালী পূজার সময় মলুটি গ্রামে প্রায় শতাধিক কালী বিগ্রহের পূজা খুব ধুমধাম করে হয়।


রামপুরহাট বা মল্লারপুর থেকে গাড়ি ভাড়া করে আধ ঘণ্টার পথে মলুটি যাওয়া যায়। দুমকা হয়েও এমনকি ম্যাসাঞ্জোর হয়েও মলুটি যাওয়া সম্ভব। মলুটিতে থাকার জন্য আছে, ঝাড়খণ্ড পর্যটন দপ্তর এবং দুমকা জেলা পরিষদের দুটি সরকারি বাংলো। আগে থেকে জানালে ভোগ খাওয়ার ব্যবস্থাও মন্দিরের পক্ষ থেকে করা হয়।


কলমে :- মৌমিতা মন্ডল

ভার্গবী পত্রিকার সহ সম্পাদক  ও মূখ্য উপদেষ্টা

প্রকাশিত বই:- 

1)নবরূপে সতীপীঠ, প্রকাশক : বিন্দু বিসর্গ পাবলিশার্স

2)নীলাচলে রথযাত্রার ইতিহাস ও মাহাত্ম্য, প্রকাশক : বিন্দু বিসর্গ পাবলিশার্স

Thursday, February 24, 2022

Ballal Dhipi : Kingdom of Ballal Sen || বল্লাল সেনের ইতিহাস | Ballal Dhipi : West Bengal

 বল্লাল ঢিপি নদিয়ার অন্যতম প্রত্নস্থল। নবদ্বীপের নিকটবর্তী মায়াপুরে কাছে বামুনপুকুরে ভক্ত চাঁদকাজীর সমাধিস্থল থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে বল্লাল ঢিপির অবস্থান। এই ঢিপির নিচে বল্লাল সেনের আমলে নির্মিত প্রাসাদ ছিল বলে অনুমান করা হয়। তবে বর্তমানে এটি পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইন অনুসারে এই অঞ্চল সংরক্ষিত করা হয়েছে। বল্লাল ঢিপি প্রায় চারশো ফুট প্রশস্থ ও উচ্চতায় পঁচিশ থেকে ত্রিশ ফুট।ঢিপিটি সবুজ ঘাসে মোড়া, আর চারিদিক কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা রয়েছে। সেন বংশের রাজা বল্লাল সেনের নামানুসারে এই ঢিপিটির নামকরণ করা হয়েছিল। ইতিহাসবিদগণ মনে করেন ধ্বংসস্তুপটি তৎকালীন সমাজের ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহর বিজয়নগরের একটি অংশ।বিজয় নগর বা বিজাপুর ছিল সেই সময়ের একটি অত্যাধুনিক শহর ও সেন বংশের রাজধানী। বিজাপুর স্থাপন করেন বল্লাল সেনের পিতা রাজা বিজয় সেন।



সেন রাজাদের রাজা বল্লাল সেনের নামাঙ্কিত এই বৃহদাকার ঢিপিতে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ ১৯৮২-৮৩ থেকে ১৯৮৮-৮৯ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে উৎখনন পরিচালনা করে। উৎখননের দ্বারা এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে বিস্তৃত প্রাঙ্গনের মধ্যে অবস্থিত বৃহদায়তন ইটের ইমারত যার চারিদিকে ছিল উচ্চ প্রাচীর। উৎখননে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পঙ্খের মূর্তি, পোড়ামাটির মানুষ, জীবজন্তুর মূর্তি, তামা ও লোহার তৈরি নানান জিনিসপত্র, পেরেক ও নানান প্রত্নসামগ্রী। অষ্টম ও নবম শতকের ধংসপ্রাপ্ত পুরাতন স্থাপত্যকীর্তির উপর পুনঃনির্মিত এই সৌধের উপরিভাগ আনুমানিক দ্বাদশ শতকের। বিভিন্ন সময়ে মেরামত, পরিবর্তন ও সংযোজনের নিদর্শনবাহী এই স্থাপত্য দ্বাদশ শতকে একটি বিশাল দেবালয় রূপ পরিগ্রহন করে।



বল্লাল সেন বাংলার সেন রাজবংশের দ্বিতীয় তথা শ্ৰেষ্ঠ নৃপতি ছিলেন। তিনি ১১৬০ থেকে ১১৭৯ সাল পর্যন্ত সেনবংশের রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন সেন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিজয় সেনের পুত্র এবং তার যোগ্য উত্তরসূরী। রাজা বল্লাল সেন বাংলার সামাজিক সংস্কার, বিশেষ করে কৌলিন্য প্রথা প্রবর্তনকারী হিসাবে পরিচিত। তিনি সুপণ্ডিত ও লেখক ছিলেন। ‘দানসাগর’ ও ‘অদ্ভুদসাগর’ তার উল্লেখযোগ্য রচনা। বল্লাল সেন তার রাজত্বের সময় বহুদূর পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। বরেন্দ্রভূমি, রাঢ়, বঙ্গ, এবং মিথিলা তার অধীনস্থ ছিল।


১০৬০ সালে রামপাল নগরে বল্লাল সেনের জন্ম হয়। তার পিতা বিজয়সেন গৌড়াধিপতি চন্দ্রসেনের কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। শৈব বরে তার জন্ম হওয়ায় বিজয়সেন পুত্রের নাম রাখেন "বরলাল", পরবর্তীতে "বল্লাল" শব্দটি তারই অপভ্রংশ হয়ে দাঁড়ায়। চৌদ্দ বছর বয়সেই তিনি অস্ত্রবিদ্যায় ও শাস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেন।


১১৬৮ সালে তিনি দানসাগর রচনা করেন এবং ১১৬৯ সালে অদ্ভুতসাগর রচনা শুরু করলেও পরবর্তীকালে তা সমাপ্ত করতে পারেন নি। পিতার মতো তিনিও শিবের উপাসক ছিলেন। অন্যান্য রাজকীয় উপাধির সঙ্গে তিনি "অরিরাজ নিঃশঙ্ক শঙ্কর" উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি দক্ষিণ ভারতের পশ্চিম চালুক্য সাম্রাজ্যের রাজকন্যা রমাদেবীকে বিয়ে করেন। অদ্ভুতসাগর গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, বৃদ্ধ বয়সে বল্লাল সেন রাজ্যভার নিজ পুত্র লক্ষ্মণসেনকে অর্পণ করেন। বল্লাল সেন জীবনের শেষ দিনগুলি রামদেবীকে নিয়ে ত্রিবেণীর কাছে গঙ্গাতীরবর্তী একটি স্থানে অতিবাহিত করেন।


12 Sept 2021 এ আমি এই  স্থান টি পরিদর্শন করি।

যারা ঘুরতে ভালো বাসেন , যারা ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র ঘুরতে ভালো বাসেন তারা মায়াপুর মন্দির গেলে এই জায়গায় একবার অবশ্যই যাওয়ার চেষ্টা করবেন। মায়াপুরের খুব কাছেই অবস্থিত এটি।

Monday, February 21, 2022

Karnasuvarna , কর্ণসুবর্ণ, karnasuvarna and Shashanka, কর্ণসুবর্ণ ও শশাঙ্কের ইতিহাস

 পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার চিরুটি (বর্তমান নাম কর্ণসুবর্ণ) রেলসেটশনের কাছে রাজবাড়িডাঙায় প্রাচীন রক্তমৃত্তিকা(রাঙামাটি) বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। কর্ণসুবর্ণ বাংলার গৌড় রাজ্যের প্রথম স্বাধীন শাসক শশাঙ্ক-এর রাজধানী। চিনা বৌদ্ধ পর্যটক সুয়ান জাং -এর বিবরণীতে এর উল্লেখ আছে। চিনা ভাষায় এই বৌদ্ধবিহারের নাম লো-টো-মো-চিহ্ ।সুয়ান জাং তাম্রলিপ্ত থেকে এখানে এসেছিলেন। কর্ণসুবর্ণ স্থানীয় ভাবে রাজা কর্ণের প্রাসাদ নামে পরিচিত। 

হর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্টের রচনা হর্ষচরিত-এ ও চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন সাং -এর ভ্রমণ বৃত্তান্ত তেও শশাঙ্ক ও কর্ণসুবর্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়। 

শশাঙ্ক ছিলেন এক গুপ্ত সম্রাটের মহাসামন্ত । আনুমানিক ৬০৬-৬০৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তিনি গৌড়ের শাসক হন। ৬৩৭-৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত শশাঙ্ক গৌড়ের স্বাধীন শাসক ছিলেন। উত্তর ভারতের ক্ষমতাধর রাজ্যগুলির সঙ্গে লড়াই করে শশাঙ্ক গৌড়ের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে  পেরেছিলেন। এই ঘটনা তাঁর বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয়। শশাঙ্কের রাজনৈতিক জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা স্থানীশ্বরের পুষ্যভূতি বংশীয় শাসক হর্ষবর্ধনের  সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব। সকলোত্তরপথনাথ উপাধিকারী হর্ষবর্ধন শশাঙ্ককে হারাতে পারেননি।

সুয়ান জাং লিখেছেন যে এই দেশটি জনবহুল এবং এখানকার মানুষেরা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। এখানে জমি নীচু ও আর্দ্র, নিয়মিত কৃষিকাজ হতো, ফুল-ফল পাওয়া যেত, জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ এবং এখানকার মানুষজনের চরিত্র ভালো ও তাঁরা শিক্ষাদীক্ষার পৃষ্ঠপোষক। কর্ণসুবর্ণে বৌদ্ধ এবং শৈব (শিবের উপাসক) উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই বসবাস করত। 

বলা বাহুল্য বাণভট্টের রচনা হর্ষচরিত-এ শশাঙ্ককে 'বৌদ্ধবিদ্বেষী' বলে নিন্দা করা হয়েছে । অন্যদিকে শশাঙ্কের শাসনকালের কয়েক বছর পরে সুয়ান জাং কর্ণসুবর্ণ নগরের উপকণ্ঠে রক্তমৃত্তিকা বৌদ্ধবিহারের সমৃদ্ধি লক্ষ করেছিলেন। শশাঙ্কের মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পর চিনা পর্যটক ই-ৎসিঙ্ -এরও নজরে পড়েছিল বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের উন্নতি। শশাঙ্ক নির্বিচারে বৌদ্ধবিদ্বেষী হলে তা হতো না। বলা যায় যে শশাঙ্কের প্রতি সব লেখকেরা পুরোপুরি বিদ্বেষমুক্ত ছিলেন না।  সুতরাং শশাঙ্ক সম্পর্কে তাদের মতামত কিছুটা অতিরঞ্জিত ছিল বলে মনে করা যেতে পারে। 

কর্ণসুবর্ণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র ও প্রসাসনিক কেন্দ্র ছিল। শশাঙ্কের আমলের অনেক আগে থেকেই সম্ভবত এই অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। রক্তমৃত্তিকা (রাঙামাটি) থেকে জনৈক বণিক জাহাজ নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয় অঞ্চলে বাণিজ্য করতে গিয়েছিল এমন নিদর্শনও পাওয়া গেছে। এর থেকে কর্ণসুবর্ণের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। 

শশাঙ্ক কোনো স্থায়ী রাজবংশ তৈরী করে যেতে পারেননি। ফলে তার মৃত্যুর পর গৌড়ের ক্ষমতা নষ্ট হয়। তাঁর মৃত্যুর পর এই শহর অল্প সময়ের জন্য কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মার হাতে চলে যায় এর পর কিছুকাল এটি জয়নগরের রাজধানী ছিল। তবে সপ্তম শতকের পরে এই শহরের কথা আর বিশেষ জানা যায় না।  পাল এবং সেন যুগের ইতিহাসের উপাদানগুলিতে এর কোনো উল্লেখ নেই।


ধারণা করা হয়— মুর্শিদাবাদ জেলার সদর শহর বহরমপুর থেকে ৯.৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ভাগীরথী নদীর তীরে এই নগরীটি ছিল। বর্তমানে স্থানটি রাঙামাটি গ্রাম হিসেবে পরিচিত। ১৯৬২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ রাঙামাটির রাজবাড়ি ডাঙ্গার উঁচু ঢিবি খনন কার্য চালিয়ে কিছু নিদর্শন পায়। এগুলোর ভিতরে ছিল-  দুটি ব্রোঞ্জ নির্মিত বৌদ্ধ মূর্তি। একটিতে বুদ্ধদেব পদ্মের উপর দাঁডিয়ে, অন্যটিতে ভূমি স্পর্শ মুদ্রায় বসে আছেন। স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে পাওয়া যায়, পঞ্চায়তন ইঁট এবং পাথরের গাঁথা ভিত্তি। এছাড়া কিছু পোড়ামটির সিলমোহর পাওয়া যায়। এসকল সিলমোহরে রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মচক্রের ছাপ, জোড়া হরিণ, গাছ ও পাখির চিত্র।

খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর দিকে রচিত বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতায় বঙ্গদেশের যে সব রাজ্যের নাম পাওয়া যায়, তা হলো- পৌণ্ড্র, সমতট, বর্ধমান, সুহ্ম, তাম্রলিপ্ত, বঙ্গ ও উপবঙ্গ। এই তালিকায় কর্ণসুবর্ণের নাম পাওয়া যায় না। হয়তো কর্ণসুর্বণ তখন প্রতিষ্ঠা পেলেই ততটা উল্লেখযোগ্য ছিল না। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে  চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন-সাং-এর ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে জানা যায়- তাঁর সময়ে বঙ্গের ভাগগুলো ছিল- পুণ্ড্রবর্ধন, কর্ণসুবর্ণ, সমতট ও তাম্রলিপ্ত।

খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন-সাং-এর ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে জানা যায়- তাম্রলিপ্ত থেকে যাত্রা করে ৭০০ লি (প্রায় ১০০ মাইল) দূরে অবস্থিত 'কিয়েলোনাসুফালানো' জনপদে উপস্থিত হয়েছিলেন।  ধারণা করা হয়, এই জনপদের কেন্দ্র ছিল কর্ণসুবর্ণ। অনেকে মনে করেন মুর্শিদাবাদের ৯ মাইল দূরে 'করুসোন-কা-গড়' হলো কর্ণসুবর্ণের ধ্বংসাবশেষ।

প্রত্নতত্ত্ববিদ ফার্গুসনের ধারণা বর্ধমানের উত্তরাংশ, সমগ্র বীরভূম জেলা, মুর্শিদাবাদ, কৃষ্ণনগর এবং প্রাচীন যশোহর জুড়ে ছিল কর্ণসুবর্ণের শাসনের অন্তর্গত ছিল। হিউয়েন-সাং-এর মতে কর্ণসুবর্ণের পরিধি ছিল ৭০০ লি (১০০ মাইল) আর রাজধানীর পরিধি ছিল ২০ লি। হিউয়েন-সাং-এর ভ্রমণকালে এই স্থান জনাকীর্ণ ছিল। বহুজাতের মানুষ এখানে বাস করতো। এখানকার ভূমি উর্বর ছিল। স্থানীয় মানুষ ছিল সরল এবং ধার্মিক। কর্ণসুবর্ণে ১০-১১টি বৌদ্ধ সঙ্ঘারাম ছিল। এসকল সঙ্ঘারামে প্রায় দুই হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষু ছিলেন। এছাড়া ছিল প্রায় পঞ্চাশটি হিন্দু দেবদেবীর মন্দির ছিল।


Karnasuvarna, Murshidabad, karnasuvarna: first capital of independed Bengal, Karnasuvarna: Capital of shashanka, karnasuvarna guptodhon,

Karnasuvarna guptodhon movie released, 

A historical place Karnasuvarna, 

Best tourist places for history lovers in Murshidabad, 

Karnasuvarna tour 2022,

Saturday, February 19, 2022

TARAPITH , তারাপীঠ , Tarapith tour in 2022, Tarapith temple, Tara Maa, এই স্থানের উৎপত্তি এবং গুরুত্ব

 

তারাপীঠ হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলার রামপুরহাট মহকুমার চণ্ডীপুর গ্রামের রামপুরহাট  ব্লকের একটি হিন্দু মন্দির, যা তার তান্ত্রিক মন্দির এবং এর পার্শ্ববর্তী শ্মশান (মহাশ্মশান) মাঠের জন্যও পরিচিত যেখানে সাধনা (তান্ত্রিক আচার) করা হয় তান্ত্রিক হিন্দু মন্দিরটি দেবী তারামাকে উৎসর্গ করা হয়েছে তারাপীঠ - তারা উপাসনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসাবে এর নামটি পেয়েছে

তারাপীঠ সাধক বামাখেপার জন্য বিখ্যাত, যিনি অবধূত বা "পাগল সাধু" নামে পরিচিত, যিনি মন্দিরে উপাসনা করতেন এবং শ্মশান ঘাটে একজন চিকিত্সক হিসাবে বসবাস করতেন এবং অন্য একজন বিখ্যাত সাধু কৈলাশপতির অধীনে যোগ তান্ত্রিক কলা অনুশীলন করেছিলেন বাবা বামাখেপা তার পুরো জীবন তারা মায়ের পূজায় উৎসর্গ করেছিলেন তার আশ্রম দ্বারকা নদীর তীরে এবং তারা মন্দিরের কাছে অবস্থিত

তারাপীঠ হল পশ্চিমবঙ্গের দ্বারকা নদীর তীরে অবস্থিত তারাপীঠ থানার সাহাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি গ্রাম এটি বন্যার সমভূমিতে সবুজ ধানক্ষেতের মাঝে অবস্থিত এটি দেখতে একটি সাধারণ বাঙালি গ্রামের মতো শহরটি বীরভূম জেলার রামপুরহাট মহকুমা থেকে 6 কিলোমিটার দূরে অবস্থিত "রামপুরহাট" এবং 'তারাপীঠ রোড' হল নিকটতম রেলওয়ে স্টেশন

এই স্থানের উৎপত্তি এবং গুরুত্ব সম্পর্কে বেশ কিছু কিংবদন্তি বর্ণিত আছে, সবই তারাপীঠ মন্দিরে দেবী তারার সাথে সম্পর্কিত একটি সুপরিচিত কিংবদন্তি শক্তিপীঠের সাথে সম্পর্কিত সতী, শিবের সহধর্মিণী, অপমানিত বোধ করেছিলেন যখন তার পিতা দক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে শিবকে তার আয়োজিত মহান যজ্ঞ তে আমন্ত্রণ জানাননি তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে শিবের প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও, যখন সতী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন, তখন দক্ষ সমস্ত পরিচারকদের সামনে শিবকে অপমান করেন এই অপমান সইতে না পেরে সতী যজ্ঞের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে জীবন ত্যাগ করেন ঘটনার এই করুণ পালা দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে শিব বন্য হয়ে গেলেন তারপর, বিষ্ণু, শিবকে শান্ত করার জন্য, তার চক্র দ্বারা সতীর দেহকে ধ্বংস করেছিলেন সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে সতীর দেহের অংশ পড়েছিল দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পতিত স্থানগুলি বিভিন্ন প্রকাশে দেবীর পূজাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এমন 51টি পবিত্র মন্দির রয়েছে যেগুলিকে সতীপীঠ বলা হয়

সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে 51টি সতীপীঠ রয়েছে যা সংস্কৃতের 51টি অক্ষরের সাথে যুক্তএই মন্দিরগুলি তন্ত্র অনুশীলনকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাসনার স্থান

মন্দিরের ভিত্তি মোটা মোটা দেয়াল, লাল ইটের তৈরি উপরের কাঠামোটি একটি চূড়া (শিকারা) দিয়ে চূড়া পর্যন্ত উত্থিত অনেক খিলান সহ আচ্ছাদিত করেছে দেবতার মূর্তি গর্ভগৃহে স্থাপিত গর্ভগৃহে দুটি তারার মূর্তি রয়েছে তারার পাথরের মূর্তিটি শিবকে দুধ খাওয়ানো মা হিসাবে দেখানো হয়েছে - "আদি মূর্তি" (তারার প্রতিমূর্তিটির উগ্র রূপ p¡j­e  দেখা যায়) একটি তিন ফুট ধাতব মূর্তি দ্বারা ছদ্মবেশিত, যা ভক্তরা সাধারণত দেখেন এটি তারাকে চারটি বাহু সহ তার জ্বলন্ত আকারে উপস্থাপন করে, একটি মাথার খুলির মালা পরা এবং একটি প্রসারিত জিহ্বা একটি রূপালী মুকুট এবং প্রবাহিত চুলের সাথে মুকুট, বাইরের ছবিটি একটি শাড়িতে মোড়ানো এবং Sh¡ ফুলের মালা দিয়ে তার মাথায় একটি রূপার ছাতা দিয়ে সজ্জিত ধাতব মূর্তির কপাল লাল কুমকুম (সিঁদুর) দ্বারা শোভিত পুরোহিতরা এই কুমকুমের একটি ছিদ্র নিয়ে তারামার আশীর্বাদের চিহ্ন হিসাবে ভক্তদের কপালে লাগান ভক্তরা নারকেল, কলা এবং সিল্কের শাড়ি প্রদান করে তারামার আদিম চিত্রটিকে "তারার মৃদু দৃষ্টিভঙ্গির নাটকীয় হিন্দু চিত্র" হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে

মন্দিরের পুরোহিতরা ভক্তদের কাছে তার মাতৃত্বের দিকটি প্রকাশ করার জন্য অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে পূজা (উপাসনা) করেনতাদের উপাসনা তারার শান্তিপূর্ণ মাতৃদর্শী রূপের সাথে দেবীর সতী পুরাণের উগ্র উত্তর ভারতীয় চিত্রকে মিশ্রিত করেতারাপীঠে, যদিও উগ্র দেবীর নরম মাতৃত্বের দিকে জোর দেওয়া হয়েছেতার প্রশংসায় স্তোত্র বা কবিতার জপও দেবীর প্রতি করা ভক্তিমূলক আবেদনের একটি অংশ

ভক্তরা পূজা দেওয়ার জন্য মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশের আগে এমনকি পূজার পরেও মন্দির সংলগ্ন পবিত্র জলাশয়ে পবিত্র স্নান করেন

 

ছাগলের ​​বলিদান মন্দিরে প্রতিদিনের নিয়মএই ধরনের ছাগল বলিদানকারী ভক্তরা দেবতার আশীর্বাদ চানতারা বলির আগে মন্দিরের কাছে পবিত্র জলাশয়ে ছাগলগুলিকে স্নান করেতারা দেবতার পূজা করার আগে পবিত্র জলাশয়ে স্নান করে নিজেদের শুদ্ধ করেতারপর ছাগলটিকে একটি দণ্ডের সাথে বেঁধে দেওয়া হয় একটি বালির গর্তে , এবং একটি বিশেষ তরবারি দ্বারা একক আঘাতে ছাগলের বলি হয়ছাগলের অল্প পরিমাণ রক্ত ​​একটি পাত্রে সংগ্রহ করে মন্দিরে দেবতাকে নিবেদন করা হয়ভক্তরাও দেবতার প্রতি শ্রদ্ধার চিহ্ন হিসাবে গর্ত থেকে কিছুটা রক্ত ​​দিয়ে তাদের কপালে দাগ দেয়

 

শ্মশান (মহাস্মাসন), অন্ধকার জঙ্গলের পরিবেশের মধ্যে, গ্রামীণ জীবন এবং বাঙালি সমাজ ব্যবস্থার অনুশীলন থেকে দূরে শহরের সীমানার শেষ প্রান্তে নদীর তীরে অবস্থিত বাংলায়, তারাপীঠের শ্মশানকেও শক্তিপীঠের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হয় এটা বিশ্বাস করা হয় যে দেবী তারাকে ছায়ার মধ্যে দেখা যায় ছাগলের রক্ত ​​পান করতে যা তার বেদীতে প্রতিদিন বলি দেওয়া হয়, তার ক্রোধ মেটাতে এবং অনুগ্রহ খোঁজার জন্য

তান্ত্রিক অনুশীলনকারীরা বিশ্বাস করেন যে তারা হাড় এবং কঙ্কালের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং শ্মশান তার পছন্দের বাসস্থান দেবী তারার ছায়ার চিত্রগুলি শ্মশানের মধ্যে দেখায় তাই তান্ত্রিক অনুশীলনকারীরা তাদের তান্ত্রিক সাধনা (আধ্যাত্মিক সাধনা) করার জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই স্থলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন; অনেক সাধু এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে সাধুরা বটগাছের মাঝে তাদের কুঁড়েঘর তৈরি করেছে এবং মাটির দেয়ালের সাথে লাল রঙের খুলি দিয়ে তাদের কুঁড়েঘরগুলিকে অলঙ্কৃত করেছে এছাড়াও, হিন্দু দেবদেবী, এবং প্রবেশদ্বারে Sh¡ ফুলের মালা এবং খুলি দিয়ে সজ্জিত একটি ত্রিশূল (ত্রিশূল) কুঁড়েঘরের সামনে একটি সাধারণ দৃশ্য মানুষের পাশাপাশি পশুর মাথার খুলি যেমন শেয়াল এবং শকুন - যা তান্ত্রিক আচারের জন্য অনুপযুক্ত - এবং সাপের চামড়া কুঁড়েঘর সাজায় তান্ত্রিক আচার-অনুষ্ঠানের জন্য এবং তান্ত্রিকদের দ্বারা মদ্যপানের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত ভাল মাথার খুলি ব্যবহারের আগে নিরাময় করা হয়; কুমারী এবং যারা আত্মহত্যা করেছে তাদের মাথার খুলি শক্তিশালী বলে বলা হয়

 

তারাপীঠে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে গৃহীত একজন সাধু যার মন্দিরটি মাতারা মন্দিরের আশেপাশে অবস্থিত, তিনি ছিলেন বামাখেপা (1837-1911) যিনি "পাগল সাধু" নামে পরিচিত বামা-খেপা, আক্ষরিক অর্থে পাগল ("খেপা") "বাম হাতের" (সংস্কৃতে "বামা" বা "বামা") পথের অনুসারী - উপাসনার তান্ত্রিক উপায় বামাখেপা, দেবী তারার প্রবল ভক্ত মন্দিরের কাছে থাকতেন এবং শ্মশানে ধ্যান করতেন তিনি ছিলেন আরেক বিখ্যাত বাঙালি সাধক রামকৃষ্ণের সমসাময়িক অল্প বয়সে, তিনি তার বাড়ি ছেড়েছিলেন এবং তারাপীঠে বসবাসকারী কৈলাসপতি বাবা নামে এক সাধুর অধীনে আসেন তিনি যোগ এবং তান্ত্রিক সাধনা (উপাসনা) সিদ্ধ করেছিলেন, যার ফলে তিনি তারাপীঠের আধ্যাত্মিক প্রধান হয়েছিলেন তিনি মালুটি গ্রামের দেবী মৌলক্ষী মন্দিরেও পুজো দিতে যান লোকেরা তাদের অসুস্থতার জন্য আশীর্বাদ বা নিরাময়ের জন্য তাঁর কাছে এসেছিল, দুঃখে বা কেবল তাঁর সাথে দেখা করতে তিনি মন্দিরের নির্ধারিত নিয়মগুলি অনুসরণ করেননি এবং ফলস্বরূপ, দেবতার জন্য নৈবেদ্য হিসাবে খাবার গ্রহণ করার জন্য মন্দিরের পুরোহিতদের দ্বারা একবার আক্রমণ করা হয়েছিল কথিত আছে: তারামা নাটোরের মহারানী- রাণী অন্নদাসুন্দরী দেবীর স্বপ্নে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং তাকে বলেছিলেন যে বামা তার পুত্র হওয়ায় তাকে আগে খাওয়াতে এই ঘটনার পর, বামাখেপাকে প্রথমে দেবতার সামনে মন্দিরে খাওয়ানো হয়েছিল এবং কেউ তাকে বাধা দেয়নি এটা বিশ্বাস করা হয় যে তারামা তার বুকে নিয়ে যাওয়ার আগে শ্মশানে বামাখেপাকে তার একটি দর্শন দিয়েছিলেন


TARAPITH, TARAPITH TOUR 2022, BIRBHUM, WEST BENGAL, TARA MAA, MAA TARA, Bamakhepa, RAMPURHAT-TARAPITH, Sidhho PithTara , Tara maa, pujaTarapith

USE GOOGLE TRANSLATE