সমস্ত পর্ব একত্রে
গল্প - নির্মলা
বিমান চন্দ্র দাস
প্রথম পর্ব
বয়স ১৯ - এর তরুনী নাম নির্মলা। তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। সুন্দরী, সুশীলা, সুঠাম গঠন। এককথায় অসামান্যা সুন্দরী। বাড়ি বিহারের ভাগলপুর তবে থাকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে, তার মামার বাড়িতে। ছোট বেলা থেকে সেখানেই তার বড়ো হয়ে ওঠা। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের বাংলা অনার্সের ছাত্রী সে। মেধার তালিকায় সমস্ত কলেজের মধ্যে প্রথম পাঁচজনের মধ্যে নাম থাকে তার তবে এতকিছু গুনের অধিকারিণী হয়েও লেশমাত্র অহংকার নেই তার । কলেজে অনেক বন্ধু বান্ধবী থাকলেও হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধু ছাড়া সেরকম কারো সঙ্গে বেশি মেলামেশা করে না সে, পড়াশোনার দিকেই ঝোঁক তার বেশি। সেই হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধুদের নাম হলো - মৃণাল, রিমি, কাকলি, সেবিনা আর সুমন্ত । প্রথম বর্ষে তো রিমি আর সেবিনা ছাড়া কারো সঙ্গে কথাই বলতো না, দ্বিতীয় বর্ষ থেকে ধীরে ধীরে সবার সঙ্গে মিশতে শুরু করে। আর এখন তো তাদের ছয়জনের বন্ধুত্বের চর্চা কলেজে সবার মুখে মুখে শোনা যায়।
তাদের ছয়জনের মধ্যে যেমন পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা হয় তেমনই জমিয়ে আড্ডাও হয় বেশ। ওদের কারো বাড়ি কলেজের কাছাকাছি নয়, কেউ আসে ট্রেনে তো কেউ বা বাসে। বাকিদের মতো তাদের বন্ধুত্বেও খুনসুটি পনা ছিল, ঝালমুড়ির ঠোঙা কাড়াকাড়ি, ক্যানটিনে আড্ডা সবই হতো, তবে সবার থেকে তাদের আলাদা করে যে জিনিসটা সেটা হলো তাদের একে অপরের প্রতি প্রান দেওয়া ভালোবাসা। একদিন কথায় কথায় নির্মলা বললো সে নাকি কোনোদিন নতুন মতিঝিল যায়নি, সোশাল মিডিয়ায় অনেককে সেখানকার ছবি পোস্ট করতে দেখেছে কিন্তু চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ এখোনো হয়ে ওঠেনি। সেই সময় তো সবাই স্বাভাবিক কথাবার্তা বলে উঠে গেল সেখান থেকে কিন্তু নির্মলা জানে না পরে বাকি বন্ধুরা মিলে নির্মলাকে নতুন মতিঝিল নিয়ে যাবার পরিকল্পনা করে নিয়েছে। পরদিন কলেজে এসে নির্মলাকে সবাই চমকে দিলো। প্রথমেই সেবিনা বললো তাহলে রবিবার কখন বেরোবি বাড়ি থেকে? সঙ্গে সঙ্গে মৃণাল বলে উঠলো তোর সেই হলুদ পোষাক টা পড়ে আসিস, তোর গত জন্মদিনে যেটা পড়েছিলি, দারুন মানায় তোকে। নির্মলার কিছু বুঝতে পারার আগেই সুমন্ত বলে উঠলো বাড়ি ফেরার সময় যদি একটু দেরি হয়ে যায় তবে মামাকে স্টেশন পর্যন্ত ডেকে নিস। নির্মলা কিছু বুঝতে না পেরে বিকৃত মুখে প্রতিক্রিয়া দিলো, মানে? তোরা কি বলছিস আমি কিছুই বুঝলাম না। সঙ্গে সঙ্গে রিমি উত্তর দিলো বা..রে.. , ম্যাডামের জন্য কষ্ট করে মতিঝিল যাবার পরিকল্পনা করলাম আর ম্যাডাম বলে কিনা কিনা কিছুই বুঝতে পারছি না।
নির্মলা 'থ'। কথাটা শুনে খুশিতে নাচবে নাকি মামা রাজি হবে কিনা সেই চিন্তা করবে ভেবে পাচ্ছিলো না। তার এরকম খুশির মধ্যেও ফ্যাকাসে মুখ দেখে কাকলি বললো তোর মামাকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমাদের, সেই চিন্তা তুই ছেড়ে দে। এবার আর খুশিতে চোখের জল থামতে পারলো না নির্মলা। রিমি, কাকলি আর সেবিনা কে জড়িয়ে ধরলো সে। পাশ থেকে মজার ছলে মৃণালের মন্তব্য - হ্যাঁ-হ্যাঁ, এত কষ্ট করে পরিকল্পনা টা আমি করলাম আর এখন ওরাই সব। ঠিক আছে তোরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদ আমি চললাম। সুমন্ত সেই সুরে সুর মিলিয়ে বললো তোর সঙ্গে আমিও আছি ভাই , চল আমরা দুজনেই কেটে পড়ি। তখন চার জন আলিঙ্গন ছেড়ে একসঙ্গে বলে উঠলো ঐ পাগলারা শোন এইদিকে। নির্মলা কান্নার স্বরে হালকা ভারী আওয়াজে বলে উঠলো এক মিনিটও শান্তি দিবি না তাই না। এই বলে মৃণালের পিঠে জোরে ব্যাগের এক আঘাত করলো। সুমন্ত নির্মলা কে রাগানোর জন্য হেসে বললো মৃনাল তোর পিঠে ধুলো ছিল সেটা ব্যাগ দিয়ে ঝেরে দিলো।
হ্যাঁ এরকমই মিষ্টি তাদের সম্পর্ক।
মৃণাল যে শুধু এবারই নির্মলার জন্য এরকম পরিকল্পনা করল তাই নয় এর আগেও করেছে। তাদের সবার মধ্যে একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক আছে ঠিকই কিন্তু ইদানীং মৃণাল নির্মলার প্রতি একটু বেশী আগ্রহ দেখাচ্ছে, একটু অন্যরকম আগ্রহ। আর সেটা সেবিনা খুব ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছিল, ব্যাপার টা সে কাকলি কে জানালো। তারপর তারা দুজনেই ঠিক করলো ব্যাপার টা নিয়ে তারা আলাদা ভাবে মৃণালের সঙ্গে কথা বলবে। এই বিষয়ে আলোচনার জন্য মতিঝিল বেড়াতে যাবার দিনই ছিল মোক্ষম সময় , আর ঠিক সেটাই করলো তারা।
গল্প- নির্মলা
বিমান চন্দ্র দাস
(দ্বিতীয় পর্ব)
সবাই একসঙ্গে নতুন মতিঝিলে প্রবেশ করলো। পুরো চত্বরটা তারা পায়ে হেঁটে ঘুরবে ঠিক করেছে। নির্দিষ্ট দূরত্ব বরাবর কয়েক জায়গায় বিশ্রামের জন্য ছাউনি করা আছে এবং তার নীচে বসার জন্য উপযুক্ত জায়গা। সেই ছাউনির তলায় তারা মাঝে মাঝে বসে জিরিয়ে নিচ্ছে। কাকলি আর সেবিনা সুযোগ খুঁজছিল কখন মৃণালকে কথা গুলো বলবে। কিছুক্ষন পরে সেই সুযোগ এসেই গেল। সুমন্ত নির্মলার ছবি তুলে দিতে ব্যস্ত ঠিক সেই সময়টাকেই কাজে লাগালো তারা। যদিও বা সেখানে রিমি উপস্থিত ছিল তবু বললো। সেবিনা শুরু করলো আচ্ছা মৃণাল একটা সত্যি কথা বলতো তুই কি নির্মলাকে ভালোবাসিস? কাকলি বলে উঠলো আমরা তোর আচরনে অনেক কিছু বুঝতে পারছি, সত্যি বলবি কিন্তু ; মিথ্যা বলে পার পাবিনা। মৃণাল নিরাশা ভরা মুখেই একটা মুচকি হাসি দিলো। রিমি পাশ থেকে বলে উঠলো কি ব্যাপার মৃণাল তলে তলে এত কিছু? মৃণাল উত্তর দিলো হ্যাঁ ভালোবাসি, নির্মলা কে ভালোবাসি, সুমন্ত কে ভালোবাসি, তোরাকে ভালোবাসি, এতে লুকানোর কিছু নেই তো। রিমি বললো এই শোন তুই কবিতা লিখিস বলে সব সময় হেঁয়ালি করে কথা বলাটা কি জরুরী। যেটা জিজ্ঞাসা করা হলো সেটার সোজাসুজি উত্তর দে না। কাকলি বললো সবাই থেমে যা অন্য ব্যাপারে আলোচনা শুরু কর, ওদের ছবি তোলা হয়ে গেছে এদিকেই আসছে। তারপর আর সেই ব্যাপারে আলোচনা করলো না কেউই। সেদিন সারাদিন খুব মজা করলো তারা। বিকেল ৩ টে নাগাদ বেড়িয়ে বাড়ির পথে রওনা দিল একসঙ্গে। তারা বাড়ি থেকে সবাই টিফিনে খাবার নিয়ে গেছিলো কারন সুমন্ত বলেছিল সেখানে যে খাবার পাওয়া যায় সেটা তার ঠিক রুচি হয়না। তবে তারা বেরোবার সময় দেখলো একটা ক্যানটিন তৈরীর কাজ চলছে। আর যেহেতু মতিঝিলের ভিতরে বাইরের খাবার খাওয়া বারন তাই তারা বেরোবার পর তাদের টিফিনে নিয়ে যাওয়া খাবার খেলো। সন্ধ্যা হয়ে এলো সবার বাড়ি পৌঁছাতে।
মৃনাল হাত মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে রাত প্রায় ১০ টার দিকে তার কবিতার ডায়েরিটা নিয়ে বসলো, আজ তারা সবাই ঘুরে এলো সেই বিষয়ে একটি কবিতা লিখতে শুরু করলো। হঠাৎ সেবিনার ফোন এলো -
মৃনাল- হ্যাঁ বল...
সেবিনা- কি করছিস?
মৃনাল- এই একটু ডায়েরিটা নিয়ে বসেছি।
সেবিনা - ও আচ্ছা, তাহলে পরে করবো নাকি?
মৃনাল- না,বলনা কোনো ব্যাপার নাই...
সেবিনা- তাহলে একটু ধর ফোনটা, কাকলি কে সঙ্গে নি, আজকে আলোচনা টা শেষ করেই ছাড়বো।
মৃনাল- উফ্ তোরাও পারিস, ছার না এসব।
সেবিনা- তুই চুপ কর, আজ এই আলোচনা শেষ করবোই।
সেবিনা কাকলি আর রিমিকে সঙ্গে নিলো, এই দেখে মৃণাল বললো সুমন্ত কেন বাকি থাকে ওকেও নিয়ে নে। সঙ্গে সঙ্গে রিমি ঠিক সেটাই করলো। প্রথমে সুমন্তকে পুরো ব্যাপার টা বুঝিয়ে বলা হলো, তার পর কাকলি বললো এবার শুরু কর মৃণাল....
মৃণাল শুরু করার আগে বললো তোদের কাছে অনুরোধ এই কথাটা নির্মলার কানে না পৌঁছায়। তোরা তো জানিস যে, যে কোনো কাজে যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তার ভালো দিক আর খারাপ দিক ভাবনা চিন্তা করে তারপর পদক্ষেপ নি। এক্ষেত্রেও তার অনথ্যা করিনি।
জানিনা নিজের অজান্তেই কখন তাকে ভালোবেসে ফেলেছি তবে সেটা কোনোদিন তার সামনে প্রকাশ করবো না, তার যথেষ্ট কারনও আছে। প্রথমত, ভালোবাসার জন্য বন্ধুত্বটা নষ্ট হোক সেটা আমি চায় না। দ্বিতীয়ত, ওদের পরিবার আর আমাদের পরিবারের সামঞ্জস্যতা দূর দূরান্ত পর্যন্ত খুঁজে পাবি না। কোথায় সে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাড়িতে ছোট থেকে বড়ো হয়েছে আর কোথায় আমি.... , কোনো মিল নেই রে আর তাছাড়া কিছু দিন আগেই গল্পের ছলে জানতে পারলাম তার বাবা নাকি তার জন্য সরকারী চাকুরি করা পাত্র খুঁজছে। তাহলে তোরাই ভাব, আমি এখোনো বেকার তাছাড়া কিছুদিনের মধ্যে যদি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েও যায় তবু সেটা সরকারী চাকুরি হবে না হবে ব্যাবসা। কারন সেটাই আমার ইচ্ছা। তাই সব দিক দিয়ে ভেবে দেখলাম আমার এই ব্যাপারে না এগোনোই ভালো।
সবাই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, সুমন্ত বললো আমি তোর সঙ্গে একমত ভাই, অন্য পথে এগোতে গিয়ে বন্ধুত্বটা নষ্ট করিস না। সেবিনা বললো তাই বলে ওকে কোনোদিন জানাবিও না? এরকম ও তো হতে পারে যে ওদের ফ্যামিলি তোকে মেনে নিলো। মৃণাল একটা অবসাদে ভরা মুচকি হাসি দিয়ে বললো সেটা হলে এই পৃথিবীতে আমার থেকে বেশী খুশি কেউ হতো না। কিন্তু তোরা এটা ভালো ভাবেই জানিস যে এর নিশ্চয়তা খুবই কম আর আমি যেটা আশঙ্কা করছি তারই সম্ভাবনা বেশী তাই এই কথা গুলো এখানেই ভুলে যা, কাল কলেজ গিয়ে সবাই স্বাভাবিক আচরণ করবি যাতে নির্মলা এসবের বিন্দু মাত্র টের না পায়। রিমি বললো এই শোন, মৃণাল যখন কথা গুলো বলছিল তখন নির্মলা আমাকে ফোন করেছিলো, ওকে একবার ফোন করতে হবে আমি রাখছি। মৃণাল বললো হ্যাঁ কর তবে খুব সাবধানে। হ্যাঁ কোনো চিন্তা করিস না রিমি এই বলে ফোনটা রেখে দিলো। মৃণাল সবার উদ্দেশ্যে বললো আমিও রাখছি রে, যেই কবিতাটা শুরু করেছি সেটা শেষ করে ঘুমাবো। এবার সবাই একসঙ্গে বলে উঠলো ঠিক আছে , শুভ রাত্রি।
নির্মলা
বিমান চন্দ্র দাস
(তৃতীয় পর্ব)
পরদিন কলেজে গিয়েই মৃণাল প্রথমেই রিমিকে চুপিসারে জিজ্ঞাসা করলো - কাল রাতে আমরা সবাই ফোন রেখে দেওয়ার পর তুই নির্মলা কে ফোন করেছিলি তখন কি বলেছিলিস? রিমি উত্তর দিল, আমি বললাম মাসি ফোন করেছিলো মা আমার ফোন থেকে কথা বলছিলো তাই ব্যস্ত পেয়েছিলিস। মৃণাল সঙ্গে সঙ্গে বাহ্বা দিয়ে বললো ভালো বলেছিস। মৃণালের এই কথাটা শেষ হতে না হতেই রিমি হঠাৎ এক অদ্ভুত ধরনের ভঙ্গিমায় বললো sorry রে, আমি তোদের কোনো দিন মিথ্যা বলি না কিন্তু বলতে হলো। মৃনাল তাকে শান্তনা দিয়ে বললো sorry তো আমাকে বলা উচিত, আমার জন্য তোকে মিথ্যা বলতে হলো। রিমি আবার একটা কি বলতে গিয়ে নিজেকে থামিয়ে নিয়ে বললো বাদ দে ওসব, চল ক্লাসের সময় হয়ে গেছে।
ক্লাসে বসেই সুমন্ত মৃণালের মুখে আর মৃনাল নির্মলার মুখে এক অস্থির ভাব লক্ষ্য করলো। মৃণালের অস্থিরতার কারন তো সুমন্ত বুঝতে পারলো কিন্তু মৃণাল নির্মলার অস্থিরতার কারনটা বুঝতে পারলো না। ক্লাসের শেষে থাকতে না পেরে মৃণাল জিজ্ঞাসা করেই ফেললো, নির্মলা তোর কি কিছু হয়েছে? নির্মলা হঠাৎ অন্যমনস্কতা থেকে তড়িঘড়ি বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করে স্বাভাবিক ভাবেই বললো কই নাতো , কি হবে? মৃণাল বললো তোর হাব ভাব কেমন লাগছে। অন্যান্য দিনের মতো স্বতস্ফূর্ত লাগছে না। নির্মলা কথাটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে বললো ও কিছু না রে, কাল রাতে ফোনে কথা বলতে বলতে বাড়ির লোকের সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে তাই আর কি। ছাড়তো ওসব, কথা কাল মতিঝিলে তুই কতগুলো ছবি তুলেছিলিস কই দ্যাখা দেখি। প্রত্যুত্তরে মৃনাল বললো হ্যাঁ দেখাচ্ছি , ততক্ষণ তোর গুলোও দেখি, তোর ফোনটা দে আমাকে । এই বলে তারা সবাই একে অপরের ফোন নিয়ে ছবি দেখতে থাকলো। তার মধ্যেই হঠাৎ করে সেবিনা বলে উঠলো কাকলি তোর দাদার বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে? কাকলি উত্তরে বললো হ্যাঁ রে, কিছুদিনের মধ্যেই নেমন্তন্ন পেয়ে যাবি। পাশ থেকে মুচকি হেসে সুমন্তর মন্তব্য নেমন্তন্নের দরকার নেই এমনি চলে যাবো। এই কথা শুনে অনেক্ষন পর সবার মুখে হাসি দেখা গেলো।
রীতিমতো কিছুদিনের মধ্যেই সবার বাড়ি নিমন্ত্রণ পত্র পৌঁছে গেলো। কারো কোনো সমস্যা ছিল না তবে নির্মলা আর সেবিনাকে নিয়ে চিন্তিত ছিল সবাই। বাইরে রাত কাটাতে হবে শুনে হয়তো আসতেই দেবে না ওদের বাড়ি থেকে। কিন্তু কাকলিও সেই ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছে। কাকলি নিজে নয় তার দাদাকে দিয়ে ওদের দুজনের বাড়িতে ফোন করিয়ে রাজি করালো। তাদের বাড়ি থেকে কোনো আপত্তি আসার আগেই সমস্ত ব্যবস্থাপনার কথা জানিয়ে দেয় কাকলির দাদা। তাদের জন্য একটি আলাদা বাড়িতে আলাদা ঘরে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে, কোনো অসুবিধা হবে না, এসব কাকুতি মিনুতি করার পর দুজনের পরিবারই রাজী হয়।
সময়মতো সবাই বিয়ের বৌভাতের দিন সকাল এগারোটায় কাকলির বাড়িতে হাজির। সবাইকে দেখে কাকলির মনে কি আনন্দ। তারা ছয়জন এক জায়গায় হতেই একটা হই-হট্টগোল বেঁধে গেল, চেঁচামেচি, নাচানাচি, হাঁসাহাঁসি পুরো বাড়ি মাথায় করে তুললো তারা। সবার নজর তাদের দিকেই, সবার মনে জিজ্ঞাসার ভাব ছেলেমেয়ে গুলো কে? কাকলির মা তো বলেই দিলো এতক্ষণে বাড়িতে বিয়ে বিয়ে মানাচ্ছে। কাকলির দাদা সুমন্তকে আগে থেকেই চিনতো ; একটি ঘরের দিকে ইশারা করে বললো আয় ভাই তোরা সবাই এঘরে এসে বোস। কাকলি বললো চল সবাই হাত-মুখ ধুয়ে নে তার পর জমিয়ে মজা হবে। পাশে থেকে কাকলির বাবার মন্তব্য এতো দূর থেকে সবাই এলো আগে কিছু খেতে দে তার পর মজা। সেবিনা বললো আসতে আসতেই আমাদের এতো খাতির ভাবায় যায় না! কাকলির হাসতে হাসতে জবাব এলো তোরা কার বন্ধু দেখতে হবে তো। নির্মলা বললো হ্যাঁ জানি এবাড়ির মহারানীর। রিমি হালকা হেসে নির্মলার কথাটায় আরো একটা বিশেষণ যোগ করে দিলো, শুধু মহারানী নয় রে আদুরে মহারানী। এর পর সবাই হাত-মুখ ধুয়ে এসে ঘরে বসতেই সবার জন্য প্লেটে মিষ্টি, দই, পাঁপড় ভাজা আর গ্লাসে সরবত নিয়ে উপস্থিত এক বালিকা। মৃনাল কাকলি কে জিজ্ঞাসা করলো তোর কাকুর মেয়ে নাকি? কাকলির উত্তরে সবাই জানতে পারলো বালিকা টি কাকলির ছাত্রী, ওদের বাড়িতেই তাদের পাঁচজনের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নির্মলা তাকে নাম জিজ্ঞাসা করায় জানতে পারলো তার নাম মীনাক্ষী তবে সবাই মিনু বলে ডাকে। যেহেতু সেবিনা মিষ্টি খায় না তাই সেই ভাগ টা গিয়ে পড়লো মিনুর কপালে। প্রথমে নিতে একটু ইতস্ততঃ বোধ করলেও পরে কাকলির সায় পেয়ে সে তুলে নেয়। এই দিকে মৃনাল মিষ্টি মুখে পুরেই জিজ্ঞাসা করলো কোন ক্লাসে পড়ো মিনু উত্তর এলো অষ্টম শ্রেণীতে। যেহেতু নিজে বাংলা সাম্মানিকের ছাত্র তাই উত্তর টা বাংলায় পেয়ে খুব খুশি হলো মৃণাল। সচরাচর সবাই কে eight -এ বলতে শোনা যায়, অষ্টম কেউ বলে না।
ইতিমধ্যে কাকলিকে কে একজন ডেকে নিয়ে গেলো। কাকলির দাদা সেই ঘরের দরজার কাছ থেকেই তারাকে বলে গেল কিছুক্ষনের মধ্যে দুপুরের খাওয়ানো শুরু হয়ে যাবে তারা যেন সময় মতো খেয়ে নেয়। সারাদিন খুব মজা করলো তারা। সন্ধ্যা হতেই আত্মীয়দের ভির বাড়তে লাগলো । ততক্ষণে তারাও নতুন পোষাক পড়ে তৈরী হয়ে নিয়েছে। কাকলি তার অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো তাদের। তার পর জোর কদমে ছবি তোলায় পাল্লা দিতে থাকলো সবাই। আর বাইরে চলছে হিন্দি গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুর্দান্ত নাচ। ছবি তোলায় তারাও কম যায়না, কাকলির দাদা বউদির কাছে স্টেজে উঠে সবাই একে একে ছবি তুলতে শুরু করলো। ঠিক তখনই রিমির চোখ মৃণালের দিকে ; সে নির্মলার দিকে একদৃষ্টে ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে আছে।
গল্প - নির্মলা
বিমান চন্দ্র দাস
চতুর্থ পর্ব
রাত তখন ১ টা বাজে অনেক আত্মীয় খাওয়া দাওয়া সেরে ইতিমধ্যে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে, তাই বিয়ে বাড়ি অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে। আমাদের চোখেও ঘুম নামক রাত টি কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসছে, তা কাকলী বুঝতে পেরে বললো একটু অপেক্ষা কর বাবাকে বলছি তোরাকে রেখে আসছে। মৃণাল বললো না না তার দরকার নেই মিনু আছে তো, ওর সঙ্গে চলে যাবো আমরা। রিমি জিজ্ঞাসা করলো কতক্ষণ লাগবে যেতে? কাকলি উত্তর দিলো তিন থেকে চার মিনিট। প্রত্তুতরে সেবিনা বললো তাহলে আমার চলে যাচ্ছি আর কাউকে পাঠাতে হবে না।
রাস্তার এক মোড়ে এত রাতে কয়েকজনের মিশ্র কন্ঠে গল্পের শব্দ এলো, একটু এগোতেই দেখে চার জন লোক এক গাছতলায় বসে মদ্যপান করছে। নির্মলা বলে উঠলো এই তো দেশের রোগ, এত রাতে কি এদের চোখে ঘুম থাকে না? বাড়ির লোকও কি কিছু বলে না এদের ? সেবিনা বললো এদের জন্যই তো আমাদের দেশে মেয়েরা সন্ধ্যা লাগলেই বাড়ির বাইরে বেরোতে ভয় পায়। মিনু ভয়ে ঢোক গিলে বলে উঠলো আমার খুব ভয় করছে। সুমন্ত বললো ধুর পাগলি ভয় কিসের, ওরা তো চার জন আর আমরা ছয় জন, কিছু বলতে এলেই সিনেমার নায়কদের মতো মেরে উড়িয়ে দিবো। এই ভাবে মিনুকে শান্তনা দিলো সুমন্ত। তার মধ্যেই রিমি বললো আমরা সবাই কে হাত লাগাতেই হবে না মৃণাল যা ক্যরাটে জানে তাতে ও একাই যথেষ্ট। নির্মলা অবাক হয়ে বলে উঠলো তাই নাকি মৃণাল, আমি জানতাম না তো! মৃণাল বললো হ্যাঁ ওই একটু আধটু আর কি। মৃণালের কথা শেষ হতে না হতেই সেবিনা বললো না রে একটু আধটু নয়, ও দারুন ক্যারাটে জানে, আমি ওর ফোনে ভিডিও রেকর্ডিং দেখেছি। এই শুনে নির্মলা বললো তোর মধ্যে আর কি কি প্রতিভা আছে একদিন ফর্দ বানিয়ে দিস তো। কবিতা লিখিস, গল্প লিখিস, ক্যারাটে জানিস আবার ছেলে হয়ে সব রান্নাও জানিস! উফ্ , সত্যি ভাবা যায় না। এই সব গল্প করতে করতেই মিনুদের বাড়ি পৌঁছে গেলো তারা।
দরজা খুলতেই দেখে এক বৃদ্ধ, অবশ্য বৃদ্ধ বলা ভুল হবে কারন বয়স একটু বেশী থাকলেও দেখে বোঝার উপায় নেই, এমনই সুঠাম দেহ তার। মৃনাল বললো নমস্কার আমরা কাকলির বন্ধু। সেই সুঠাম দেহ বিশিষ্ট ব্যক্তিটি উত্তর দিলো হ্যাঁ এসো এসো তোমাদের জন্যই বসে আছি, আমি মিনুর দাদু। মিনু কে নির্দেশ দিলো তার দাদু, 'মিনু যা বাথরুম টা দেখিয়ে দে, ওরা হাত-মুখ ধুয়ে নিক। ' যেমনি বলা তেমনি কাজ। তারা হাত-মুখ ধুয়ে আসতেই মিনুর দাদু তাদের ঘর দেখিয়ে দিলো। পাশাপাশি দুটি ঘরে তাদের জন্য আগে থেকেই খুব সুন্দর ভাবে ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। নির্মলা মিনু কে তাদের সঙ্গে ঘুমোতে বললো। তাদের ঘুমোতে রাত প্রায় দুটো পেরিয়ে যায়।
সকালে সবাই উঠে একে একে ফ্রেশ হয়ে আসতেই দেখা যায় বারান্দায় সবার জন্য চেয়ার সাজিয়ে রাখা আছে আর পাশে একটা চেয়ারে মিনুর দাদু বসে। সবাই এসে বসা মাত্র মিনু আর এক বৃদ্ধ মহিলা চা বিস্কুট নিয়ে এলো। পরোক্ষনেই জানা গেল উনি মিনুর ঠাম্মি। মিনুর মা- বাবা গেছে ব্যাঙ্গালোর ডাক্তার দেখাতে। দিন তিনেকের মধ্যেই ফিরবে বলে জানালেন দাদু। আর মিনুর এক দিদি আছে হোস্টেলে থাকে, দেয়ালের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখালো -এই তার ছবি। এইভাবে দাদুর সঙ্গে চললো কিছুক্ষন গল্প। জানা গেল দাদু ভারতীয় সেনাবাহিনী তে থেকে ১৩ বছর দেশের সেবা করেছেন। এটা শোনার পর মৃণাল বুঝতে পারলো ওনার দেহের গঠনের আসল রহস্য। সকাল প্রায় আটটা নাগাদ মিনু দের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পৌঁছায় কাকলি দের বাড়ি আর সেখান থেকে প্রায় ন'টা নাগাদ বেড়িয়ে পরে বাড়ির পথে। পরের দিন থেকে আবার কলেজ আর পড়াশোনা। তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার দিন কাছিয়ে আসছে, তাই দিন দিন পড়ার চাপ ও বাড়ছে সবার তবুও দু-এক দিন পর পর সবাই ২০-২৫ মিনিট করে কনফারেন্স কল-এর এর জন্য সময় বের করে নেয় তারা।
গল্প- নির্মলা
বিমান চন্দ্র দাস
পঞ্চম পর্ব
মৃণাল বেশ কিছুদিন ধরে নির্মলার মধ্যে একটা অস্বস্তি বোধ লক্ষ্য করছিল, যটা দিন দিন বেড়েই চলেছে ।একদিন কলেজে আলাদা ভাবে তাকে জিজ্ঞেস করলো মৃণাল, আচ্ছা তোর কি কিছু হয়েছে? কদিন থেকেই তোর মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। নির্মলা প্রত্যুত্তরে কিছু একটা বলতে গিয়েও আটকে নিলো, বললো সেরকম কিছু না রে। মৃণাল তখন আর জোর করলো না। রাতে হঠাৎ মৃণালের চঞ্চলতা বেড়ে যায়। নির্মলার ঐরূপ আচরনের কারন জানার আগ্রহ চরম সীমায় পৌঁছায়। তাই সে আর থাকতে না পেরে ফোন করলো নির্মলাকে। বেশ কিছুক্ষন ফোন বেজেই যাচ্ছে কিন্তু ধরছে না, প্রায় কেটে যাবার মুহূর্তে ফোনটা ধরলো। ভারাক্রান্ত গলায় আওয়াজ এলো হ্যাঁ বল। মৃণাল বলতে যাবে এত দেরী কেন ফোন ধরতে, কিন্তু বলতে গিয়ে থেমে গেল সে। পরিবর্তে জিজ্ঞাসা করলো তুই কাঁদছিলি? একথা শুনে নির্মলা আবার অঝোরে কাঁদতে লাগলো। কি হয়েছে জানতে চাইবে নাকি তাকে শান্তনা দিবে বুঝে উঠতে পারছিলো না মৃণাল। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলো দুজনেই। নির্মলা বুঝতে পারলো তার কান্না শুনে মৃণালের ও গলার আওয়াজ টা ভারী হয়ে এসেছে। নির্মলা বললো সেরকম কিছু হয়নি রে এর জন্য আবার তুই কাঁদছিস কেন? তার জবাবে মৃনাল বললো হ্যাঁ সত্যি তো সেরকম কিছুই তো হয়নি সেই জন্য তখন থেকে তোর কান্না থামছে না। সেরকম কিছু হয়েছে নাকি সেরকম কিছু হয়নি সেটা বলবি তাহলে তো বুঝবো। নির্মলাও আর না বলে থাকতে পারলো না। বলতে শুরু করলো সে, - দ্বিতীয় বর্ষের পর থেকেই বাড়ি থেকে মাঝে মাঝে ফোন করে জানাতো, বিয়ের জন্য ভালো পাত্রের খোঁজ এসেছে। কবে বলে ছেলে এই চাকরি করে কবে বলে ওই চাকরি করে। এসবের জন্য আমি বিরক্ত হয়ে যেতাম। একদিন রাগ করে বাবাকে বলেছিলাম ঠিক আছে আমি আর পড়াশোনা করবো না, আমি কালই চলে আসছি দিয়ে দাও আমার বিয়ে। সেই ঘটনার পর কিছুদিন এই সব কান্ড-কারখানা বন্ধ ছিলো। বাড়ি থেকে ফোন আসলেও বিয়ের জন্য কিছু বলতো না। কিন্তু কাল মা যেই কথা গুলো ফোনে বললো সেগুলো শোনার পর আমার কিছু ভালো লাগছে না রে। এই কথাটা বলতে বলতেই নির্মলার চোখ দুটো আবার কান্নায় ভরে উঠলো। মৃনাল আবার শান্ত করলো তাকে। তার মা এমন কি কথা বলেছে জানতে চাইলো মৃনাল। নির্মলা আবার বলতে শুরু করলো, বললো তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার পরই নাকি আমাকে ভাগলপুর নিয়ে চলে যাবে, আমি আর তোদের সঙ্গে থাকতে পারবো না রে। কথাটা বলা মাত্র আবার অঝোরে কাঁদতে লাগলো নির্মলা। এই বারে মৃণালের মুখ থেকেও কোনো কথা বেরোলোনা। কিছুক্ষন পর কাঁদতে কাঁদতেই পুনরায় বলা শুরু করলো নির্মলা, মা বলছিলো বাবা নাকি বাড়িতে খুব বকাবকি করেছে। বলেছে এতদিন কিছু বলিনি কিন্তু আর না এবার যে সমন্ধ টা এসেছে এরকম আর কোনোদিন পাবো না তাই তোমার মেয়েকে বলো ফাইনাল পরীক্ষার পরই বাড়ি চলে আসতে। আর মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতে হবে না, যদি পড়ার ইচ্ছা থাকে তাহলে বিয়ের পর ঐ বাড়ি থেকে পড়বে। তারা তো বলেছে বিয়ের পর পড়াতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। এতো কিছু শোনার পরও এখনও কিছু বলছে না মৃণাল, তবে নির্মলা বুঝতে পারছে যে সেও কাঁদছে। নির্মলা আরো বলতে থাকলো, তোকে এগুলো কলেজে বলিনি বলতে শুরু করলে কান্না থামাতে পারতাম না। এই রকম অবস্থাতেও আমি কিভাবে সবার সামনে এতো হাসি-খুশি থাকি আমি জানি। কথা বলতে বলতেই নির্মলা বলে উঠলো তুই লাইনে আছিস তো? মৃণালের দিক থেকে উত্তর এলো হ্যাঁ। আসলে ফাইনাল পরীক্ষার পর তারা আর একসঙ্গে থাকবে না একথা শুনে দিশেহারা হয়ে গেছে মৃণাল, কি বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারছিলো না সে। হঠাৎ করে নির্মলা বলে উঠলো, দেখেছিস কি পাগলি আমি, তখন থেকে তোর পড়াশোনা নষ্ট করে বকবক করেই যাচ্ছি। এবার মৃনালের মুখ ফুটলো, আরে না না, তুই বল আমি ঠিক পরে পড়ে নিবো। তারপর সে মনে মনে বিড়বিড় করে বললো আমি তো চাই তুই সারাজীবন আমাকেই সবকিছু বল, কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। নির্মলা জিজ্ঞাসা করলো কিছু বললি? মৃণাল বললো হ্যাঁ, বললাম যে বন্ধুদের ই যদি এসব না বলিস তো কাকে বলবি। নির্মলা অবাক হয়ে বললো বন্ধু! শুধু বন্ধু! তুই আমাকে শুধু বন্ধু ভাবিস? একথা শুনে মৃণাল হতবাক। সে বুঝে উঠতে পারছিলো না নির্মলা কি বলতে চাইছে। তার পরেই নির্মলা আবার বললো তুই আমাকে শুধু বন্ধু ভাবিস? আমি তো ভাবতাম সবার থেকে প্রিয় বন্ধু ভাবিস। একথা শুনে একটু স্বস্তি পেলো মৃণাল। সে তো এক মুহূর্তের জন্য ভেবে নিয়েছিলো নির্মলা হয়তো তার সব মনের কথা জেনে গেছে। এর পর মৃণাল উত্তর দিল শুধু প্রিয় বন্ধু নয় রে, তুই যে আমার কে সেটা তুই নিজেও জানিস না। নির্মলা অবাক হয়ে বললো মানে? পরোক্ষনেই মৃণাল বলে উঠলো আমাদের বন্ধুত্বটা প্রিয় বন্ধুর থেকেও বেশি কিছু। যেই সম্পর্কের এখোনো কোনো নামকরন হয়নি এই পৃথিবীতে। হ্যাঁ আমরা বন্ধু ঠিকই, তবে তার মধ্যেও নাম না জানা এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক লুকিয়ে আছে আমাদের মধ্যে। নির্মলা বললো হ্যাঁ ঠিক বলেছিস, তাই হয়তো আজ আমার এই ঘটনা গুলো তোকেই বললাম।
যাই হোক, অনেক্ষন কথা হলো এবার ফোন রাখছি। মৃনাল বললো হ্যাঁ রাখ তবে কথা দে কাল কলেজ আসা পর্যন্ত একবারও কাঁদবিনা। নির্মলা বললো আর যদি কাঁদি? প্রত্তুতরে মৃণাল বললো যদি কাঁদিস তাহলে কাল কলেজে এসে আবার তোকে মেরে কাঁদাবো। একথা টা শুনে এতো মন খারাপের মধ্যেও নির্মলা একটু হেঁসে বললো ঠিক আছে কাঁদবোনা। এই বলে ফোনটা রাখলো দুজনেই। ফোন রাখার শেষ মুহূর্তে নির্মলা কে একটু হাসাতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মৃণাল।
গল্প- নির্মলা
বিমান চন্দ্র দাস
ষষ্ঠ পর্ব
সব কিছু স্বাভাবিক চলছিল। হাসি-কান্না, রাগারাগি, মজা, আড্ডা, সুখ-দুঃখ সব মিলিয়ে ভালোই কাটছিল সবার। তবে তার মধ্যে মৃণাল আর নির্মলার সম্পর্কটা গভীর থেকে আরো গভীরে যাচ্ছিলো। মৃণাল শত চেষ্টার পরও নির্মলার থেকে দূরে থাকতে পারছিল না। আর নির্মলাও দিন দিন মৃণালের কাছাকাছি আসতে শুরু করেছিল। সেদিন ছিল কলেজের বসন্ত উৎসব, হলুদ শাড়ী পরিহিতা কপালে টিপ ও দুই গালে ও কপালের টিপের পাশে আলতো করে তিরঙ্গাকারে রঙ্ লাগানো। এই রূপ মোহমাখা রূপবতী কন্যাটির দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না মৃণাল। সেই কন্যাটি আর কেউ না নির্মলা নিজেই। ঠিক যেন স্বর্গ থেকে আগত অপ্সরা মনে হচ্ছিল। পাশ থেকে সুমন্ত মৃণালের কানের কাছাকাছি তার মুখটা নিয়ে গিয়ে বললো এই ভাবে কি দেখছো বৎস? একটু অন্য দিকেও ঘুরে তাকাও। মৃণাল বললো দেখতে দে রে, আর যে এই দিনটা ফিরে পাবো না, তাই স্মৃতি গুলোই মনে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকবো। কথাটা শুনে সুমন্তর মনটা যেন কেমন হয়ে গেল, সে সত্যি এটা ভাবেনি যে এটাই তাদের কলেজ জীবনের শেষ বসন্ত উৎসব। সেবিনা ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিল, সে সুমন্তর কাছে এসে বললো কিরে আজকের দিনে তোকে হঠাৎ মনমরা দেখাচ্ছে কেন? সুমন্ত বললো তুই কি ভেবছিস এটাই আমাদের কলেজ জীবনের শেষ বসন্ত উৎসব। সেবিনা বললো হ্যাঁ জানি, বাড়িতে এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি, ভাবতে ভবতে চোখের জলও বেরিয়েছে কয়েক ফোটা, কিন্তু এই মুহূর্তে সেগুলো ভেবে আজকের দিনটা বৃথা যেতে দিবো না। এমন ভাবে উপভোগ কর যাতে এই দিনটা সারাজীবন স্মৃতির পাতায় উজ্জ্বল হয়ে ভেসে ওঠে। পাশ থেকে নির্মলা শুনতে পেলো কথাটা। এগিয়ে এসে সেবিনার কথায় সেও সহমত জানালো। তার পর সবাই মত্ত হয়ে উঠলো রঙের খেলায়। কারো গালে রঙ, কারো কপালে রঙ তো কারো আবার মনে রঙ। হ্যাঁ মৃনালের মনে এতো রঙ জমেছে যে তার একবার ইচ্ছা হলো নির্মলা কে পাশে ডেকে পরিনীতা সিনেমার বাবাই দার মতো তার সিঁথিতে এক মুঠো আবির ভরে দিবে, কিন্তু যাই হোক পরক্ষোনেই নিজেকে সংযত করলো সে। সবাই সবাই কে রঙে রাঙিয়ে দিচ্ছে তার মধ্যেই কাকলি মৃণালের কাছে এসে বললো বল কি হয়েছে? মৃণাল কিছু বুঝতে না পেরে বললো কই কি হয়েছে! কাকলি মুচকি হেসে বললো তোর আবিরের হাতের মুঠোর কাপুনি নির্মলার দিকে তাকিয়ে তোর চোখের মধ্যে একটা ভয়ের আভাস এগুলোই প্রমান করে দিচ্ছে তুই ওকে নিয়েই ভাবছিস। মৃণাল প্রত্তুতরে বললো ও কিছু না রে, কয়েক সেকেন্ডের জন্য বাবাই দা হবার শখ জেগেছিল মনে তারপর নিজেকে সামলে নিলাম। কাকলি ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিমায় বলে উঠলো ও লে লে লে তাই নাকি ছেলের কি শখ। মৃণাল তাকে চুপ করতে বললো, তোকে বললাম বলে তুই আবার হাটে হাঁড়ি ভাঙ্গিস না। নির্মলার দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বললো ঐ দ্যাখ বেশী দূরে নাই শুনতে পাবে। ইতিমধ্যে রিমি আর সেবিনা তাদের কথোপকথনের মধ্যে হাজির। কাকলি বললো সে শুনতে পাক তবু তোর ইচ্ছা পূরণ করবোই। রিমি বললো কিসের ইচ্ছা রে ? কাকলি হাসতে হাসতে বললো এখানে এখন পরিনীতা সিনেমার বাবাই দার মেহুলের সিঁথিতে আবির ভরে দেওয়ার দৃশ্য টি অভিনয় করে দেখানো হবে, তবে চরিত্রের পরিবর্তন হবে, আমি হবো বাবাই দা আর মৃণাল হবে মেহুল। একথা শুনে সেবিনা আর রিমির সে কি হাসি। এত কিছুর মধ্যেও মৃণালের নির্মলার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকানো একটুও কমলো না। সত্যি তারা দিনটিকে এমনভাবে উপভোগ করলো সারা জীবন স্বরণীয় হয়ে থাকবে। সেদিন বাড়ি ফেরার পথে সবার মন খারাপ কারন এই রকম দিন আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। কিন্তু পরীক্ষার পড়ার চাপে সব যেন কেমন এলো মেলো হয়ে যাচ্ছে । পরীক্ষা আরম্ভ হয়ে গেছে তাই কিছু দিন থেকে ফোনে কারো সঙ্গে সেরকম ভাবে কথা হয়ে ওঠে না। যেটুকু হয় তা পড়ার বিষয়েই হয়। অবশেষে সেই দিনটি এসে উপস্থিত হতে চলেছে যেই দিনের আশা কোনো ছাত্র ছাত্রী -ই করে না । কিন্তু বিধির বিধান তো আর কেউ পাল্টাতে পারে না ।
গল্প- নির্মলা
বিমান চন্দ্র দাস
সপ্তম পর্ব
আর একটাই পরীক্ষা বাকি ছিল, তার পর হয়তো কে কোথায় হারিয়ে যাবে ঠিক নেই। কয়েকদিন থেকেই কারো মনে স্ফূর্তি নেই, সবার মনমরা। নির্মলা তো কেঁদেই ফেলে যখন-তখন। যখনই তার মনে আসে পরীক্ষার পর তাকে চলে যেতে হবে ভাগলপুর তখনই সে আর চোখের জল থামিয়ে রাখতে পারে না। আসলে তারা এমন একটা বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছে যে কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে চায় না। অগত্যা সবাই মুখোমুখি হলো সেই দিনটার। হ্যাঁ আজ শেষ পরীক্ষা। শুধু তারা ছয়জনই নয় সকল ছাত্রছাত্রী রা নিজ নিজ পরীক্ষা কক্ষ থেকে বেড়িয়ে নিজ নিজ প্রিয় মানুষটির কাছে হাজির। সবার মুখে পরীক্ষা শেষ হবার স্বস্তির থেকে বন্ধু দের থেকে দূর হবার কষ্টটায় বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেকেই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে, এই দৃশ্য যে কতটা করুন সেটা শুধুমাত্র তারাই বুঝতে পারবে যারা বাস্তবে এই ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্না, আলিঙ্গন, তার মাঝেই কিছু সেলফি নেওয়া, সত্যি অদ্ভুত ও কষ্টকর অভিজ্ঞতা এটি।সেবিনা বললো চল আমরাও একটা গ্রুপ সেলফি নি, কথা মতো সঙ্গে সঙ্গে কাজও সম্পন্ন হলো। কারো স্বাভাবিক কন্ঠে কথা বেরোচ্ছিলো না, সবার গলায় কান্নার আভাস। সত্যি এই স্কুল আর কলেজ জীবনটা বড়োই বিচিত্র। ছেলেবেলায় এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে না হয় সেই জন্য কাঁদতে হতো, আর বড়ো হয়ে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বেড়িয়ে যেতে হচ্ছে তাই কাঁদতে হচ্ছে।
সেদিন বাড়ি এসেও মন ভালো নেই কারো। রাত ১০.৩০ নাগাদ কনফারেন্স কল করলো রিমি, সেদিন প্রায় ৩ ঘন্টার ও বেশি সময় কথা হয়েছিল তাদের। কথার মাঝে কাকলি রেগে গিয়ে বললো সেই কলেজ থেকে তোরা এমন নাকি কান্না শুরু করেছিস মনে হচ্ছে আমাদের আর কোনো দিন কথা হবে না, আমরা তো হারিয়ে যাচ্ছি না, সবাই সংস্পর্শে থাকবো। তোরা সবাই যদি একই রকম ভাবে মন খারাপ করে বসে থাকিস তাহলে কি ভালো লাগে বলতো? নির্মলা বললো ঠিক বলেছিস, তাহলে আমি তোদের মনটা একটু ভালো করে দি কেমন। কাকলি জিজ্ঞাসা করলো কিভাবে। নির্মলা বললো একটা খুশির খবর আছে, আমরা সবাই কাঠগোলা বাগান বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছি। একথা শুনে সবার গলার আওয়াজ টা পাল্টে গেল। নির্মলা আরো বলতে থাকলো, আমি বিকেলে বাড়িতে ফোন করেছিলাম তার পর বলি যে আমি এখন কয়েকদিন বাড়ি যাচ্ছি না, সামনে ২৭ তারিখে আমার জন্মদিন টা এখানেই বন্ধুদের সঙ্গে কাটাতে চায়। আর সেকথায় বাড়ি থেকে রাজি হয়েছে। রিমি বললো আরে তাই তো আজ তো ২১ তারিখ হয়ে গেল আর ৬ দিন পরেই তো তোর জন্মদিন। একথা শুনে একটু হলেও সবার মন ভালো হলো।
এই কটা দিন কোনো রকমে দিন কাটিয়ে এলো সেই দিন । সবাই সকাল সকাল তৈরী হয়ে বেড়িয়ে পড়লো লালবাগের সেই ঐতিহাসিক স্থানটির দিকে, যেখানে শুধু মুর্শিদাবাদ নয় লুকিয়ে আছে পুরো ভারতবর্ষের তথা বিশ্বের অজানা ইতিহাস ।
গল্প- নির্মলা
বিমান চন্দ্র দাস
অষ্টম পর্ব
শুভ জন্মদিনের বার্তার সঙ্গে ঘুম ভাঙ্গলো নির্মলার। সেদিন সবাই সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়েছিলো লালবাগের উদ্দেশ্যে। প্রায় ১০ টা নাগাদ হাজির হলো কাঠগোলা বাগান বাড়ির সামনে, ততক্ষণে কাকলি আর সুমন্ত সেখানে এসে অপেক্ষা করছিল। সবাই এক জায়গায় হতেই একটা খুশির আমেজ।
রাস্তার পাশেই একটি সিংহদ্বার তার সামনে অনেক মানুষের সমাগম। সেই দ্বারের ভেতরে প্রবেশ করতেই দুই ধারে অগনিত গাছ আর তার মধ্যেই কিছু ঐতিহাসিক স্তম্ভ আর কিছু অশ্বারোহী মূর্তি। মধ্যের সরু রাস্তা ধরে কয়েক পা এগোতেই দেখা গেল টিকিট কাউন্টার। সেখানে টিকিট কেটে এবার আসল জায়গায় প্রবেশ করলো তারা। কাকলি বললো একটা গাইড নিলে ভালো হতো। মৃণাল তার উত্তরে বললো গাইডের দরকার হবে না, চল আমি সব বুঝিয়ে বলছি। সুমন্ত মজার ছলে বলে উঠলো হ্যাঁ চল আজ আমাদের বাংলার শিক্ষক মহাশয় ইতিহাস পড়াবেন। হাসি-ঠাট্টা করতে করতেই এগোচ্ছে তারা। মুখ্য বাড়িটি পৌঁছাবার আগেই বাম দিকে গুপ্ত সুড়ঙ্গ আর ডান দিকে চিড়িয়াখানা। মৃণাল বললো এগুলো পড়ে দেখবো আগে প্রধান যে বাড়িটা সেটা দেখে নি। সেই কথামতো এগিয়ে গেল তারা। এবার কাঠগোলা বাগান বাড়ির সামনে উপস্থিত হলো। কি সুন্দর দৃশ্য, বাড়িটির সামনেই একটা বিশাল পুকুর। পুকুরটির চারকোনে ও বাড়ির সামনে এবং তার বিবরীত পাড়ে সুন্দর ভাবে মোট ছয়টি ঘাট বাঁধানো। বাড়ির সামনের ঘাটটিতে একটি সুন্দর ফোয়ারা। সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতেই পুকুরে দেখাগেলো রঙ - বেরঙের মাছ জলে খেলা করছে। হঠাৎ করেই মৃণালের গলার আওয়াজ, এই মাছ গুলো খাওয়া হয় না। আর এগুলোর মধ্যে যদি কোনো মাছ মারা যায় তাহলে তাকে কবর দেওয়া হয়। নবাবী আমল থেকেই চলে আসছে এই রীতি। কবরের স্থানটি পরে দেখতে পাবি তার আগে চল বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করি। ভেতরে প্রবেশ করতেই সেবিনা বললো জিনিস গুলো কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। মৃণাল জবাব দিলো, না চেনার কিছু নেই এখানে অনেক সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে। সেবিনা একটু উঁচু কন্ঠে আগ্রহের সঙ্গে বলে উঠলো হ্যাঁ মনে পড়েছে 'বলো দুগ্গা মাই কি' নামক সিনেমায় দেখেছি, এতক্ষণে সব মনে পড়ছে। মৃণাল তার কথা আবার শুরু করলো, এই ঐতিহাসিক বাড়িটির গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো হলো - কষ্টিপাথরের সিংহাসন, ১৮ ফুট উঁচু বেলজিয়াম আয়না, ৭৫ ফুট উঁচু বিনা স্তম্ভের কাঠের সিঁড়ি, মার্বেল টেবিল... ও হ্যাঁ এখানে যে মার্বেল টেবিল আছে তার সঙ্গে তাজমহলের মার্বেলের মিল পাওয়া যায়। চলতে চলতে সবাই একসঙ্গে থমকে গিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো মৃনালের দিকে। কাকলি বললো সত্যি তোকে যত দেখি ততই অবাক হয়ে যায়। নির্মলা ইয়ার্কির ছলে বললো তুই তো গাইড দের ব্যাবসা গুটিয়ে দিবি দেখছি। মৃণাল মুচকি হেসে বললো বেশি বকিস না সামনে এগিয়ে চল।
মুখ্য বাড়িটি থেকে বেড়িয়ে পূর্ব দিকে এগিয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে আঙ্গুলের ইশারায় দেখালো মৃণাল, ঐ যে ওখানে সামান্য উঁচু স্টেজের মতো আছে দেখছিস, ওটাকে জলসাঘর বা নাচমহল বলে। চল দেখে আসি। নাচমহলটির উপরে উঠে মৃনাল তার বক্তব্য চালু রাখলো, এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা নাচের আসর বসতো। ততকালীন নবাবী লোকেরা, ইংরেজ সাহেবরা ও ধনী ব্যাবসায়ী রা এখানে আসতো মনোরঞ্জনের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু নর্তকী কে নিয়ে আসা হতো এখানে। তখনকার ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় তাদের মধ্যে একজন ছিলো হীরা বাঈ। সে নাকি প্রতি সন্ধ্যায় নাচ করার জন্য ৫০০০ মুদ্রা নিতো। তার একটি বিশাল ছবি হাজারদুয়ারী তে টাঙ্গানো আছে। সেখান থেকে তারা দুই ধারে গোলাপের বাগান ছাড়িয়ে এগিয়ে চললো সামনের দিকে। একটু এগোতেই একটা ছোট স্তম্ভ লাগোয়া দুই ধারে দুটো মাছের মূর্তি দেখা গেল। মৃনাল বললো এখানেই মাছেদের কবর দেওয়া হয়। মৃণাল বললো চল এবার ঐ মন্দিরটার মধ্যে প্রবেশ করি। তারা সবাই মন্দিরের বাইরে নির্দিষ্ট স্থানে জুতো খুলে হাত-পা ধুয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। এই মন্দিরের ভেতরে মোবাইল ব্যাবহারে নিষেধাজ্ঞা আছে। তাই তারা প্রবেশ করার আগেই সুইচ অফ করে দিলো। এমনকি এই মন্দিরে প্রবেশ করার পূর্বে সবাই কে কথা বলতেও বারন করা হয়। তবে ধর্ম - বর্ণ নির্বিশেষে সকল পর্যটকদেরই এখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। সেখান থেকে বেড়িয়ে নির্মলা বললো নবাব দের বাগানবাড়ি তে মন্দির কিভাবে এলো বুঝতে পারলাম না। এটা শোনার পর মৃণাল একটানা ১০ মিনিট বক্তৃতার ন্যায় বলতে থাকলো।
মৃণাল :- আমি এই জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, দেখতে চাইছিলাম প্রথম প্রথম আমার মনে যে প্রশ্ন আসতো সেটা তোরাও ভাবিস কিনা। এই বলে পুরো ইতিহাস বলতে শুরু করলো মৃণাল, এটি নবাবদের তৈরী নয়। রাজস্থান থেকে আগত এক ব্যাবসায়ী এটি নির্মাণ করান। তিনি ছিলেন জৈন ধর্মাবলম্বী, তাই এই মন্দিরটিও জৈন মন্দির। মন্দিরটি আদিনাথ মন্দির বা পরেশনাথ মন্দির নামে পরিচিত। আদিনাথ হলো জৈন ধর্মের প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভনাথের আরেক নাম। মন্দির টি প্রথম থেকে এখানে ছিলো না ১৮৭৩ সালে তৎকালীন বাড়িটির মালিক তার মায়ের ইচ্ছা তে এটি বানান। আর এই বাগানবাড়ি টি তৈরী করান বর্তমান জিয়াগঞ্জ শ্রীপত সিং কলেজের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীপত সিং দুগরের পূর্বপুরুষ লক্ষীপত দুগর। তারা চার ভাই ছিলেন - লক্ষীপত সিং দুগর, ধনপত সিং দুগর, মহীপত সিং দুগর ও জগপত সিং দুগর। তারা এখানে ব্যাবসার সূত্রে এসেছিলেন, এখানে এসে তখনকার সব থেকে ধনী ব্যাবসায়ী জগৎ শেঠের সঙ্গে তাদের ভালো সম্পর্ক হয়। সেই সুবাদেই তৎকালীন নবাবের কাছে মাত্র ১২০০ টাকায় ২৫০ বিঘা জমি কিনে নেন। তার পরই তৈরী করান এই বাগান বাড়ি টি। সিংহদ্বার দিয়ে প্রবেশের পরে পরেই যে চারজনের অশ্বারোহী মূর্তি দেখেছিলি সেগুলো এদের ই চার ভাইয়ের। বর্তমানে লক্ষীপত সিং দুগরের দশম প্রজন্ম সঞ্জয় সিং দুগর ও সিদ্ধার্থ সিং দুগর এই প্রাসাদটির দেখাশোনা করেন। তারা বর্তমানে কলকাতায় থাকেন। আসার সময় মুখ্য বাড়িটির পিছনে যে ভগ্নাবশেষ টি দেখলি সেটা অতীতে অতিথিশালা ছিলো। এর পর তারা বাড়িটির সামনে যে পুকুর টা আছে তার বিপরীত পাড়ে এলো, সেখান থেকে বাড়িটির অসাধারণ দৃশ্য চোখে পড়লো। আহা! কি দৃশ্য মন জুড়িয়ে গেলো সবার। মৃনাল বললো চল ঐ গাছের তলায় বসে টিফিন টা বের করে খেয়ে নি তার পর সুড়ঙ্গ আর চিড়িয়াখানা টা দেখবো। খাওয়ার পর পাঁচ মিনিট পুকুর পাড়েই বসলো তারা। কেউ ছবি তুলতে ব্যস্ত, কেউ পাইচারী করতে শুরু করলো। সেই সময় রিমি নির্মলাকে ডেকে বললো, নির্মলা আমি আর মিথ্যা বলতে পারছি না, আর কতদিন লুকিয়ে রাখবো? কিছু মনে করিস না আমি তোর প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গলাম আজই ওকে সব বলে দিবো। নির্মলা রিমির মুখে হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, এরকম করিস না বন্ধু। যা বলার এখান থেকে ফেরার পর বলিস। কালই আমি ভাগলপুর চলে যাবো আবার কবে তোদের সঙ্গে দেখা হবে জানিনা, অন্তত আজকের দিনটা কারো চোখে জল দেখতে চাই না রে। মৃনাল বেশি দূরে ছিল না তাই এইসব কথোপকথন গুলোর কিছুটা তার কানে এলো। সে কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে রে রিমি? রিমি মৃণালের কন্ঠ শুনে আচমকা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বললো, ও তেমন কিছু না, পরে বলবো। নির্মলা চাইছিলো না এই কথাটা নিয়ে আলোচনা শুরু হোক তাই সে রিমি আর মৃণালের কথার মধ্যেই বলে উঠলো চল এবার চিড়িয়াখানা টা দেখি। এবার মৃণাল সেই কথা থেকে বেড়িয়ে এসে নির্মলার কথার উত্তরে বললো হ্যাঁ যাবো তার আগে চল সুড়ঙ্গ টার ব্যাপারে একটু জেনে নি। সবাই একসঙ্গে সুড়ঙ্গ টার সামনে এসে দাঁড়ালো। মৃনাল আবার আগের ভঙ্গিতেই বলতে শুরু করলো, এই সুড়ঙ্গ টি ইংরেজদের চোখে ধুলো দিয়ে লুকিয়ে ব্যাবসা করার জন্য বানানো হয়েছিলো। এই সুড়ঙ্গ টি সরাসরি চলে যায় এখান থেকে প্রায় চার কিমি দূরে জগৎ শেঠের বাড়ি। এই সূত্রে বলে রাখা ভালো জগৎ শেঠের পুরোনো এবং বড়ো বাড়িটি কিন্তু গঙ্গা নদীর তলায় তলিয়ে গেছে। আর তাই এই সুড়ঙ্গ টি সবসময় জলমগ্ন থাকে। এমনকি গঙ্গা নদীর জল বাড়লে এই সুড়ঙ্গের জলস্তর ও বারে আর কমলে কমে। এই কথা শুনে সুমন্ত আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইলো তাহলে এখন যেই জগৎ শেঠের বাড়িটি সবাই দেখতে যায় সেটা কি নকল? মৃণাল জবাব দিলো না সেটাও জগৎ শেঠেরই বাড়ি, কিন্তু যে বাড়িটা নদীর গর্ভে তলিয়ে গেছে তার তুলনায় এটি খুবই ছোট।
মৃণাল বললো সন্ধ্যা হবার আগেই সবাই কে বাড়ি পৌঁছাতে হবে চল এবার চিড়িয়াখানা টা দেখেই বেড়িয়ে পড়বো।
চিড়িয়াখানায় প্রবেশ করতে করতে মৃণাল বললো এর আগে আমি যখন এসেছিলাম তখন চিড়িয়াখানা টাও ঐ অতিথিশালার মতো ভগ্নাবশেষ হয়ে পড়েছিলো ইদানীং এটিকে ঠিক করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তাই এই ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো না। যা অনুভব করার তা নিজে চোখে দেখেই কর। তবে হ্যাঁ এটুকু জানি যে যখন চিড়িয়াখানাটা ঠিক ছিল তখন এখানে বাঘ, সিংহ বা কোনো মাংষাষী পশু রাখা হতো না। কারন রাখলে তাদের মাংস খেতে দিতে হবে, আর জৈন রা তাদের বাড়ির চৌকাঠে পর্যন্ত মাংসের স্পর্শ পড়তে দেশ না।
তবে এখন কি কি আছে সেটা ভেতরে গিয়েই বুঝতে পারবো। ভিতরে গিয়ে তারা দেখলো কি সুন্দর সুন্দর পাখি। যেসব পাখির তারা চোখে দেখা তো দূরের কথা নামও শোনেনি। বিভিন্ন দেশের পাখি আছে সেখানে, এমনকি উট পাখিও চোখে পড়লো। এছাড়াও খরগোস, বিভিন্ন মাছ, হাঁস বিভিন্ন প্রাণী ছিলো।
সেখান থেকে বেড়িয়ে সবাই ঠিক সময়ে বাড়ি পৌঁছে গেলো। রাত্রি তখন সবে ৯ টা বেজেছে, ঠিক এমন সময় মৃণালের ফোন বেজে উঠলো। বিপরীত দিকে রিমির আওয়াজ। রিমি কাঁদতে কাঁদতে বলনো মৃনাল আমাকে ক্ষমা করে দিস, তোকে আমি মিথ্যা বলেছি। মৃণাল কিছু বুঝতে না পেরে বললো এই পাগলি কি হয়েছে কাঁদছিস কেন? রিমি একটা ছোট্ট শ্বাস নিয়ে বললো নির্মলা সব জানে রে। মৃণালের মাথায় যেন পাহাড় ভেঙ্গে পড়লো। মৃণাল এবার একটু বুঝতে পারলো বললো মানে, কি বলছিস তুই? রিমি আবার কাঁদতে কাঁদতে বললো হ্যাঁ রে সব জানে নির্মলা। এমন কি তুই ফোনে যা বলিস সেইসবও জানে। তোর মনে আছে আমরা একদিন মতিঝিল থেকে এসে রাতে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলাম আর সেদিন নির্মলা আমাকে ফোনে পাইনি, ব্যস্ত বলেছিল। সেদিনই ও বুঝে গেছিলো। পরে আমাকে পরিবারের সদস্যের দিব্যি দিয়ে সব জানতে চায়, তাই অগত্যা আমাকে সব সত্যি বলতে হয়। এমনকি তার পরেও যা যা বলতিস সব তাকে বলতে হতো। কিন্তু তোকে কিছু বলতে পারতাম না কারন আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলো। আজ তা ভেঙ্গে দিয়েছি। আজ কাঠগোলা বাগানের সামনে পুকুর পাড়ে টিফিন করার সময় যখন তুই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলি কি ব্যাপার তখন এই ব্যাপারেই কথা হচ্ছিল। মৃনাল নির্বাক। কি বলবে বা কি করবে ভেবে পাচ্ছিলো না। তার মধ্যেই রিমি বলতে থাকলো, ওকে আটকা মৃণাল, কাল ই ওর ভাগলপুর চলে যাবার কথা, যেতে দিস না ওকে। আমি জানি ওই ও তোকে খুব ভালোবাসে । তোকে ছাড়া ওই ও ভালো থাকবে না আমি জানি। মৃণাল তখন আর কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলো না। তার মাথার মধ্যে তখন হাজারো চিন্তা ভির করেছে। রিমি মৃণালের অবস্থা বুঝতে পারছিলো। কিন্তু সেই মুহূর্তে কারো কিছু করার ছিলো না।
গল্প- নির্মলা
বিমান চন্দ্র দাস
অন্তিম পর্ব
সকাল তখন ৭ টা মৃণাল ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে বেড়ানোর জন্য তৈরী হচ্ছে । সে এখন দিল্লিতে, আজ গ্রামের বাড়ি ফিরছে। কারন আগামী কাল হোলি, আর গত ১২ বছরে এমন কোনো বছর যায়নি যে বসন্ত উৎসবে সে গ্রামের বাড়িতে থাকেনি। হ্যাঁ ১২ বছর। দেখতে দেখতে ১২ বছর হয়ে গেল। এই ১২ বছরে প্রতি বছরে হোলির দিন মৃণাল বাড়িতেই সময় কাটায়। দুপুরে খাবার পর ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে বেড়িয়ে পরে কলেজের উদ্দেশ্যে। কলেজের সামনে গিয়ে আনমনে কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তার পর মাথার মধ্যে এসে ভির করে পুরোনো দিনের স্মৃতি। সেগুলো ভাবতে ভাবতেই নিজের অজান্তেই কখন চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। চোখের সামনে হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রী দের রঙের উৎসবে মেতে উঠতে দেখে মনে পড়ে যায় তাদের কলেজ জীবনের কথা। তবে বেশিক্ষন সেখানে সে দাঁড়ায় না, মানুষ তাকে চিনে ফেললে সেখানে ভির জমে যেতে পারে । তার কারন সে এখন স্বনামধন্য ব্যাক্তি। একাধারে সে স্বনামধন্য ব্যাবসায়ী আবার তার পাশাপাশি স্বনামধন্য লেখকও বটে। কলেজের সামনে থেকে একটু হেঁটে গিয়ে নদীর পাড়ে বসে সে। তার পর শুরু হয় ফোন। রিমি, সেবিনা, কাকলি, সুমন্ত সবাই জানে বসন্ত উৎসবে বিষেশত হোলির দিন মৃণালের ফোন আসবেই। শুধু মাত্র কথা হতো না নির্মলার সঙ্গে। ১২ বছর আগে কাঠগোলা বাগান বাড়িতে সেই শেষ কথা আর শেষ দেখা হয়েছিল তাদের। তার পর কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই নির্মলার। এমনকি ফোন নম্বরটাও পরিবর্তন করে নিয়েছে। ভাগলপুর যাবার ২ দিন পর নির্মলা মৃনাল কে একটা হোয়াট্সঅ্যাপ বার্তায় বলেছিল ভুল করেও আমার খোঁজে কোনোদিন ভাগলপুর আসিস না, তার পর থেকে আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। নদীর পাড়ে বসে ফোন করার পর সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি ফিরে যায় মৃনাল, আর তার পর শুরু হয় ডায়েরি লিখা। এবারো তার অন্যথা হবে না। দিল্লি থেকে বাড়ি ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। তার গ্রামের বাড়িতে তার ভাই, ভাইয়ের বউ আর ৮ বছরের এক মেয়ে থাকে। মৃনাল অনেকবার বলেছে তার কলকাতার ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকতে, কিন্তু তার ভাইয়ের বক্তব্য সে গ্রামের বাড়িতেই থাকতে চায়। বর্তমানে ভারতবর্ষের 6 টা বড়ো বড়ো ব্যাবসার মালিক মৃণাল। মৃণাল অনেকটা পথ অতিক্রম করে এসেছে তাই দরজাটা এঁটে দিয়ে ঘুমোতে যাবে এমন সময় দরজার বাইরে থেকে তার ভাইয়ের ডাক শুনতে পেল। দরজা খুলতেই দেখে একটা চিঠির খাম হাতে দাঁড়িয়ে তার ভাই। খামটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো এই নে তোর নামে আজ সকালে এই চিঠি টা এসেছে । তুই আসছিস জেনে ফোন করে আর বলিনি। চিঠি টা হাতে নিয়ে বললো আচ্ছা ঠিক আছে। দরজা লাগানোর আগেই তার ভাইকে বললো নির্মলা টিউশন থেকে এলে এই চকলেট গুলো দিয়ে দিস। রাত্রে খাবার কিছুক্ষন আগে তুলে দিস তখন বসে ওর সঙ্গে গল্প করবো। এই বলে দরজাটা এঁটে দিলো। চিঠির খামটা টেবিলে রেখে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লো। রাত 8 টা নাগাদ মৃনালের ঘুম ভাঙ্গলো। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে নির্মলা ছুটে এলো মৃণালের ঘরে। এই নির্মলা হলো মৃণালের ভাইয়ের মেয়ে, নামটা মৃণালের ই দেওয়া। মৃণাল হাত মুখ ধুয়ে ঘন্টা খানেক তার ভাইজির সঙ্গে গল্পের ছলে খেলা করলো। তার পর নির্মলার মা এসে বললো দাদা রান্না হয়ে গেছে, কখন খাবেন বলবেন। মৃণাল বললো ও আচ্ছা, ভাই কোথায়? উত্তর এলো আপনি রসমালাই খুব পছন্দ করেন তাই বাজার গেছে শ্যাম ময়রার দোকান। এক্ষুনি চলে আসবে। মৃণাল বললো ঠিক আছে ভাই এলে একসঙ্গে খেয়ে নিবো।
পরদিন সকালে উঠে একটু গ্রামটা ঘুরতে বেড়োলো মৃণাল। দুপুরে খাবার পর হঠাৎ মনে পড়লো কালকের চিঠির কথা, দেখলো টেবিলের উপর যথা স্থানেই রাখা আছে সেটি। হাতে তুলে নিয়ে এপিঠ ওপিঠ উল্টে দেখলো কারো নাম লিখা নেই। তবে তার নিজের ঠিকানাটার দিকে ভালো করে দেখা মাত্র অবাক সে! এতো নির্মলার হাতের লিখা! এর পর আর কিছু না দেখেই সঙ্গে সঙ্গে চিঠি টা খুলে পড়তে শুরু করলো সে।
"জানিনা এখন আমাকে ঘৃনা করিস, নাকি আমার উপর রাগ করে আছিস, নাকি এখনো আগের মতোই ভালোবাসিস? তবে এটা ভালো করে জানি যে, প্রেমিকা নির্মলার উপর রেগে থাকলেও বন্ধু নির্মলার উপর রেগে থাকতে পারবি না।
আমি জানি তুই হোলি তে গ্রামের বাড়িতে থাকিস তাই হোলির পর দিনই আসছি আমি। পারলে রিমি কে কথাটা জানিয়ে দিস, সম্ভব হলে বাকিদের ও বলে দিস। ৪ দিন থাকবো মুর্শিদাবাদে। তাদের কে বলিস পারলে যেন দেখা করে।
ইতি -
তোদের হতভাগী নির্মলা। "
চিঠিটা পড়ার সময় মৃণালের চোখের জল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উথাল-পাথাল করতে লাগলো চোখেই। চিঠি টা পড়ার পর অনেক প্রশ্ন এসে ভির করলো মৃণালের মনে। সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটের যুগে নির্মলা চিঠি কেনো লিখলো? চিঠির শেষে সে নিজেকে হতভাগী কেন বলেছে? আর সব থেকে বড়ো প্রশ্ন হলো যোগাযোগ করলই যদি তাহলে ১২ বছর পরে কেন? এত দিন কোথায় ছিল সে? সে কেমন আছে সেটা পর্যন্ত লেখেনি চিঠিতে, তাহলে কি সে ভালো নেই? এই প্রশ্ন গুলো মনকে চঞ্চল করে তুললো মৃণালের। বিছানায় শুয়ে সেগুলোই ভাবতে থাকলো সে, কিন্তু কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না। সেদিনও প্রতি বছরের ন্যায় কলেজের সামনে গেল মৃণাল। নদীর পাড়ে বসে রিমি কে ফোন করলো, একে একে সবাই কে যুক্ত করলো রিমি। রিমি এখন বীরভূম জেলার রামপুরহাটে থাকে। স্বামী আর দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার তাদের। সেবিনা ও কাকলির অবস্থাও তাই। তবে সেবিনা থাকে বহরমপুরেই আর কাকলির বিয়ে হয়েছে নদীয়ার কৃষ্ণনগরে। আর সুমন্ত তার এক দুর সম্পর্কের আত্মীয়ের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করেছে বহরমপুরেই। আর মৃণালের জন্য শুধু মুর্শিদাবাদ নয় বা শুধু এরাজ্য নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখনো বিয়ের প্রস্তাব আসে, কিন্তু তার এক বাক্য, সে বিয়ে করবে না। ফোনে মৃনাল চিঠির কথাটা বলতেই সবাই অবাক। প্রথমে রেগে কাকলি বললো এতোদিনে মনে পড়েছে মহারানীর। কিন্তু পরোক্ষনেই কান্না নেমে এলো সবার চোখে। সবাই একসুরে বলে উঠলো কাল সূর্য পূর্ব দিকে উঠুক বা পশ্চিমে, ভূমিকম্প আসুক বা মহাপ্রলয় হোক, যেভাবেই হোক না কেন, কাল আমরা সবাই আসছি তোর বাড়ি। মৃণাল বললো ঠিক আছে। সেদিন মৃণাল অনেক কেনাকাটা করে একটু রাত করে বাড়ি ফিরলো। তার হাতে এতো বাজারের থলি দেখে তার ভাই জিজ্ঞাসা করলো, কি ব্যাপার দাদা এতো মালপত্র কিসের? মৃণাল বললো কাল আমার কয়েকজন কলেজের বন্ধু আসবে, কই নির্মলার মাকে একটু ডাকতো। একথা বলতে বলতেই নির্মলার মা সেখানে হাজির। মৃনাল তার দিকে বাজারের থলি গুলো এগিয়ে দিয়ে বললো, এই নাও কাল তোমার একটু কষ্ট বাড়িয়ে দিলাম। সেদিন রাতে মৃণালের অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম এলো না। তার মনের অবস্থা কাউকে বলতে পারছে না সে, শুধু মনের কথা গুলো কলমের রেখা দিয়ে ডায়েরির পাতাকে বলে রাখছে। পরদিন সকালে উঠেই মৃনালের ব্যস্ততা তুঙ্গে। আজ ১২ বছর পরে নির্মলার সঙ্গে দেখা হবে এই ভেবেই তার মনে জলকম্পের ন্যায় ঢেউয়ের টালমাটাল খেলা চলছে। সকাল তখন ৯ টা হবে, মৃণালের ভাইজি বাড়ির উঠোন থেকে দৌড়ে ভেতরে গিয়েই তার মাকে বলছে, মা জ্যাঠামশায়ের ঘরে যেই আন্টি গুলোর ছবি আছে সেরকমই দেখতে একটা আন্টি এসেছে। কথাটা শুনে মৃণালের বুকে যেন পাহাড় ভেঙ্গে পড়লো। এক ছুটে বাইরে এসে দেখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নির্মলা। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের চোখে চোখ রেখে তাকানো, তার পর কেউ কারো দিকে তাকিয়ে উঠতে পারলো না। সেই কয়েক সেকেন্ডের তাকানোতেই মৃণাল দেখলো নির্মলা সেই আগের নির্মলা নেই। অপ্সরার মতো দেখতে তার চেহারা আজ মলিন হয়ে এসেছে। যে মুখে সর্বদা বসন্ত ঝরা হাসি লেগে থাকতো সেই মুখে আজ হাসির চিহ্ন মাত্র নেই। সেই হাসিট যেনো কোনো এক অজানা ভুলে ঢাকা পড়ে গেছে। তার চেহারার ঔজ্জ্বলতা যেন হাজারো চিন্তার ভিরে কোথায় হারিয়ে গেছে। কোনো এক ব্যর্থতা যেন তার পিছু ধাওয়া করে বেড়াচ্ছ তাকে। সব মিলিয়ে সে আজ জরাগ্রস্ত। তবে সব থেকে যে বিষয় টা মৃণালকে অবাক করলো তা হলো নির্মলার সিঁথিতে সিঁন্দুর দেখতে পেলো না। তাহলে কি সেও মৃণালের মতোই ... নাকি ...? যাই হোক পরে সেটা জিজ্ঞেস করে নেওয়া যাবে। মৃণাল তার দিকে তাকানোর ভান করে বললো আয় ঘরে আয়। ঘরের দিকে এগিয়ে যেতেই মৃনালের ভাইজি অর্থাৎ ছোট নির্মলার দিকে চোখ পড়লো তার। ঘরে বসতেই জিজ্ঞাসা করলো মিষ্টি মেয়েটা কে রে? জবাবে মৃণাল বললো আমার ভাইজি। নির্মলা হঠাৎ তার চেয়ার টা মৃণালের বিপরীতে ঘুরিয়ে নিয়ে বসলো। মৃণাল বললো এটা কি করছিস? চেয়ার টা ঘুরিয়ে নিলি কেন? প্রত্তুতরে নির্মলা বললো যতক্ষণ না আমার সব কথা বলা শেষ হচ্ছে ততক্ষণ তোর দিকে তাকাতে পারবো না। মনে হয় আমি সেই অধিকার হারিয়ে ফেলেছি। মৃণাল এই কথাটা শুনে কষ্ট পেলো, বুঝতে পারলো কতটা কষ্ট বুকে জমিয়ে বেঁচে আছে সে। তবু বললো এসব আর একবারও বলবি না, বন্ধুত্বে কোনো অধিকার কোনোদিন শেষ হয় না। তাই এতো দিন পরে হলেও তোর মন সায় দিয়েছে আর ছুটে এসেছিস বন্ধুত্বের টানে। তবু যদি তুই চাস কথা শেষ না করা পর্যন্ত আমার দিকে তাকাবি না, তাহলে ওইভাবেই থাক বারন করবো না। এসব কথা বলতে বলতেই ঘরের বাইরে থেকে আওয়াজ এলো, দাদা চা নিয়ে এসেছি। মৃণাল বললো, হ্যাঁ ভেতরে চলে এসো দরজা খোলা আছে। টেবিলের উপর রেখে দাও নিয়ে নিচ্ছি। ছোট নির্মলাও তার মায়ের পিছু পিছু ঘরে ঢুকে পড়েছে, তাকে কাছে টেনে নিয়ে নির্মলা বললো তোমার নাম কি? সে উত্তর দিলো আমার নাম নির্মলা। ও তাই, বা খুব মিষ্টি নাম তোমার। কোন ক্লাসে পড়ো? তৃতীয় শ্রেণীতে। বা খুব ভালো। চা টা টেবিলে রেখে হঠাৎ বলে উঠলো ওমা দিদি আপনি ওই দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসেছেন কেন? নির্মলা একটু ইতস্ততঃ বোধ করে বললো ও কিছু না, দেয়ালের ছবি গুলো দেখছিলাম, আমাদের কত পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। ও আচ্ছা, এই বলে ছোট নির্মলা কে নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। মৃণাল বললো নে এবার শুরু কর তোর কথা। নির্মলা বললো হ্যাঁ শুরু করছি, তবে প্রথমেই বলে রাখি, আমার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো কথা বলবি না, তোর যা জিজ্ঞাসা করার সব শেষে করবি। এই বলে শুরু করলো নির্মলা - রিমি তোকে সবই বলেছে সেই সূত্রে তুই জানিস যে আমি ওই বিষয় গুলো সবই জানতাম। এমনকি এটাও জানি যে কাঠগোলা থেকে বেড়িয়ে আসার পরদিন আমি যেদিন ভাগলপুর চলে যায় সেদিন তুই আমার মামার বাড়ি পর্যন্ত গেছিলি। হয়তো সবকিছু বলতে বা শুধু একবারের জন্য দেখা করতে। কিন্তু তুই জানতিস না সেদিন আমার ট্রেনের সময় টা ছিলো খুব সকালেই। তুই মামার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই দিদা আমাকে ফোন করে বলেছিল তোর কথা। আমি চলেগেছি শুনে তুই বাড়ির ভেতরেও যাসনি, বাড়ির সদর দরজার কাছ থেকেই ফিরে চলে গিয়েছিলি। তুই হয়তো অনেক ভেবেছিস যে আমি সব জানা সত্ত্বেও বা আমারো তোকে ভালোলাগা সত্ত্বেও বা আমরা পালিয়ে বিয়ে করে নিতে পারতাম তবু তোকে কোনো দিন কিছু বলিনি কেন? কারন রিমি বলেছিলো তুই একদিন ফোনে বলেছিলি তুই তোর বাবা মাকে ফেলে রেখে কোথাও পালাবি না। আর সেদিনের পর থেকে তোর প্রতি আমার ভালোবাসা আর সম্মান টা আরো বেড়ে গেছিলো। তবে আমি এটাও জানতাম যে যদি আমার বাড়ি থেকে সম্পর্কটা মেনে নেয় তাহলে তোর থেকে বেশী খুশি আর কেউ হবে না। তাই এখান থেকে বাড়ি যাবার পর দিনই আমি সাহস করে ব্যাপারটা বলি বাড়িতে। কিন্তু আমার বদমেজাজী বাবার মাথায় এতো রাগ উঠেছিলো কথাটা শুনে যে আমার গায়ে হাত তুলতেও এতটুকু বাধেনি। শুধু তাই নয় এও বলেছিল যে আমার বিয়ের নেমন্তন্নে তুই যদি ওখানে যাস তাহলে তোকে আর বেঁচে ফিরতে দেবে না। সেদিনই তোকে আমার ফোন থেকে শেষ কথাটা লিখেছিলাম যে, কোনো দিন আমার খোঁজ করিস না। তার পরই সিম কার্ড টা ভেঙে দিয়ে ফোনটা বাড়িতে দিয়ে দি, তার পর থেকে আজ পর্যন্ত ফোন ব্যবহার করিনি। আর নির্মলা জীবিত লাশ হয়ে বাঁচতে শিখে গেলো। রীতিমতো বাবার দেখা ছেলের সঙ্গেই বিয়ে হলো আমার। বিয়ের দুই মাসের মাথায় একটা পথদুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। সরকারি চাকরি করতো, ৫০ হাজার টাকা বেতন পেতো ঠিকই কিন্তু বাসর রাত থেকে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত এমন কোনো রাত যায়নি যেদিন আমাকে শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়নি, বাধা দেওয়া তো দূর তার চেষ্টা করতে গেলেই জুটতো খারাপ ভাষায় গালাগালি আর মার। শুধু সমাজের চোখেই আমাদের বিয়ে হয়েছিলো, কিন্তু আমি তার বউ ছিলাম না, ছিলাম শুধু তার শারীরিক চাহিদা মেটানোর যন্ত্র। বিয়ের কয়েক দিনের মধ্যেই যখন আমার বাড়িতে এসব জানতে পারলো তখন থেকে বাবা আমার সামনে আসে না। আমি বিধবা হবার কিছুদিন পরই বাবা অসুস্থ হয়ে পরে। একটাই মেয়ে তো তাই ধাক্কা টা সামলাতে পারেনি হয়তো। তার পর বাড়ির লোক আবার অন্য জায়গায় বিয়ের কথা তুলেছিলো। আমি বলেছিলাম যদি আমাকে তোমাদের সামনে জীবিত দেখতে চাও তাহলে দয়া করে আমাকে নিয়ে আর কিছু ভাবতে এসো না। তার পর থেকে আর কেউ কোনো দিন কিছু বলেনি। তার পর তো ৫ বছর গৃহবন্দী দশায় জীবন কাটিয়েছলাম। আমার এই অবস্থা দেখে মাও ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলো তাই ভাবলাম, না, আর এভাবে বাঁচা যাবে না। অনেকবার সুইসাইড করতেও ইচ্ছা হয়েছিল কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে করতে পারিনি। ৫ বছর পরে বাইরের পরিবেশ টা দেখলাম। ততদিনে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছিলো। এতো দিন বাবা অসুস্থ থাকার ফলে সংসারেও অনটন দেখা দিয়েছিলো। তার পর আমি সংসারের হাল ধরলাম। আমাদের বিশাল সম্পত্তির মধ্যে কয়েক বিঘা বিক্রি করে সেই টাকা ব্যাঙ্কে রাখলাম, সেখান থেকে যা সুদ আসে তাতেই সংসার চলে যায়। সেই টাকা থেকে একটা ল্যাপটপ ও কিনি যাতে বাড়িতে বসেই কোনো কাজ করতে পারি। ৫ বছর পরে আবার সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবার পর জানতে পারি তোদের কথা। তুই কত বড়ো ব্যাবসায়ী হয়েছিস, দেশজুড়ে তোর নামডাক। আর তোর লিখা গুলোও একটাও বাদ রাখিনা। সারাদিন কাজের পর রাতে খাবার পর রোজ তোর লিখাগুলো পড়ি। সব পত্রিকার সম্পাদক রা তোর লিখা ছাপাতে চায়, এতটাই ভালো লিখিস তুই। আমার কথাগুলো শুনে হয়তো ভাববি যে 5 বছর পরেই যদি আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিলাম তবে এতো দিন তোদের সঙ্গে যোগাযোগ করিনি কেনো? হয়তো আর কোনো দিন দেখা করতাম না কিন্তু আজ থেকে ১০ দিন আগে হঠাৎ বাবা আমাকে উনার ঘরে ডেকে পাঠায়, গিয়ে দেখি আগে থেকেই মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে। আমি বললাম বাবা আমি এমন কি অপরাধ করেছি যে তুমি জীবিত থেকেও ১২ বছর আমি তোমার মুখ দেখিনি? বাবা ঐভাবে শুয়ে থেকেই কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিলো , ধুর পাগলি তুই কেন অপরাধ করবি, করেছি তো আমি। অপরাধ নয়, পাপ করেছি। সেই পাপের শাস্তি ভোগ করছি আমি। ততক্ষণে দুজনেই কাঁদছিলাম। আমি বললাম ওসব ভেবে তুমি কষ্ট পেও না বাবা, আমার ভাগ্যে যা ছিলো তাই হয়েছে। তার পর বাবা বললো আমার একটা কথা রাখবি মা? বললাম হ্যাঁ রাখবো বলো। কিন্তু বাবা যে এরকম কিছু একটা চেয়ে বসবে জানতাম না। হঠাৎ বাবা বললো মৃণালের কাছে গিয়ে আমার হয়ে ক্ষমা চেয়ে আসতে পারবি? আর হয়তো বেশিদিন বাঁচবো না, তার আগে এই প্রায়শ্চিত্ত টুকু করে যেতে পারলে একটু শান্তি পাবো। সেই কথা রাখতেই আমার আসা। সব যে কি থেকে কি হয়ে গেল?
একদিকে নির্মলা এগুলো কাঁদতে কাঁদতে বলছে আর অন্য দিকে মৃণাল সব শুনতে শুনতে কাঁদছে। শুধু বাবার তরফ থেকেই নয় আমিও তোর কাছে ক্ষমা প্রার্থী, তাই আমাকেও পারলে ক্ষমা করে দিস। নির্মলার কথা শেষ হলো। প্রায় ২ মিনিট কারো মুখ দিয়ে কোনো কথা বেড়োলো না দুজনেই অনর্গল কেঁদে গেল। তারপর মৃনাল বললো এবার আমার দিকে মুখ করে বসতে পারিস। নির্মলা ঘুরে বসলো কিন্তু তখনো মুখ তুলে তাকাচ্ছিলো না মৃণালের দিকে। মৃণাল বললো আমার সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞেস করে নে তার পর এইসবের উত্তর দিচ্ছি। নির্মলা বললো তোর প্রত্যেকটা ইন্টারভিউ আমার দেখা আছে তাই মোটামুটি তোর ব্যাপারে অনেক কিছু জানি। আগে তুই ক্ষমা করেছিস কিনা সেটা বল তার পর যদি ইচ্ছা হয় তবেই কিছু জিজ্ঞাসা করবো। মৃণাল তার নিজের ফোনটা নির্মলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো তোর বাড়িতে ফোন টা লাগিয়ে দে আমি তোর বাবার সঙ্গে কথা বলবো। এবার মৃনালের চোখের দিকে তাকালো নির্মলা। মৃণাল বললো তাকিয়ে লাভ নেই যা বললাম তা কর। নির্মলা সেই মতোই কাজ করলো, প্রথমে তার মা ফোনটা ধরে, নির্মলা বললো বাবাকে ফোনটা দাও মৃণাল কথা বলবে। এর পর নির্মলার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে মৃণাল কানে ধরলো আর বিপরীত দিকে নির্মলার বাবা। বিপরীত দিকে কান্নার আওয়াজ পেয়ে বলতে শুরু করলো মৃণাল। দেখুন কেঁদে লাভ নেই। যা হয়ে গেছে সেটা আমরা কেউই পাল্টাতে পারবো না। আর আপনি আমার কাছে ক্ষমা চাইতে পাঠিয়েছেন? একমাত্র মেয়ের বাবা হয়ে নিজের চোখে মেয়েকে বিধবা দেখছেন এর থেকে বড়ো প্রায়শ্চিত্ত আর কি হতে পারে বলুন। দেখুন ১০ বছর হলো আমার বাবা-মা দুজনেই গত হয়েছেন, তাই আপনাকে বাবা বলেই ডাকছি। আমি যদি আপনার কাছে একটা ভিক্ষা চাই তাহলে দিবেন। এবার মুখ ফুটলো নির্মলার বাবার, এরকম কেন বলছো বাবা, আমার কাছে কিছুই নেই যা তোমাকে দিতে পারবো। মৃণাল বললো আমি যদি বলি আমার জীবনের সবথেকে মূল্যবান জিনিস টা আপনার কাছেই আছে। এবার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো নির্মলা। সে বুঝতে পারছে মৃণাল কি বলতে চাইছে। মৃণাল নির্দিধায় বলে ফেললো আপনি রাজী থাকলে আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। নির্মলা বলে উঠলো কি বলছিস এসব? মৃণাল এক হাতের ইশারায় চুপ করতে বললো নির্মলা কে। তার পর প্রায় মিনিট খানেক কানে ফোন ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো মৃণাল। বিপরীত দিক থেকে কি উত্তর আসছে বুঝে উঠতে পারছে না নির্মলা। তার পর কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিলো মৃণাল। তখনই বাইরে থেকে গাড়ির আওয়াজ এলো। মৃণাল জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলো রিমি আর সেবিনা এসেছে। মৃণাল সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা বিছানায় ফেলে দিয়ে নির্মলার কাছে এসে তার হাত দুটো ধরে বললো বিয়ের পরে ওগো, হ্যাঁগো বলে ডাকতে পারবো না কইরে নির্মলা এইভাবেই ডাকবো কিন্তু, এই পাগলাটার পাগলামি সহ্য করতে পারবি তো? একথা শোনা মাত্র নির্মলা মৃণালকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে তার পিঠ ভাসালো।
🙏নমস্কার🙏
গল্প - নির্মলা
বিমান চন্দ্র দাস
প্রথম পর্ব
বয়স ১৯ - এর তরুনী নাম নির্মলা। তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। সুন্দরী, সুশীলা, সুঠাম গঠন। এককথায় অসামান্যা সুন্দরী। বাড়ি বিহারের ভাগলপুর তবে থাকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে, তার মামার বাড়িতে। ছোট বেলা থেকে সেখানেই তার বড়ো হয়ে ওঠা। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের বাংলা অনার্সের ছাত্রী সে। মেধার তালিকায় সমস্ত কলেজের মধ্যে প্রথম পাঁচজনের মধ্যে নাম থাকে তার তবে এতকিছু গুনের অধিকারিণী হয়েও লেশমাত্র অহংকার নেই তার । কলেজে অনেক বন্ধু বান্ধবী থাকলেও হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধু ছাড়া সেরকম কারো সঙ্গে বেশি মেলামেশা করে না সে, পড়াশোনার দিকেই ঝোঁক তার বেশি। সেই হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধুদের নাম হলো - মৃণাল, রিমি, কাকলি, সেবিনা আর সুমন্ত । প্রথম বর্ষে তো রিমি আর সেবিনা ছাড়া কারো সঙ্গে কথাই বলতো না, দ্বিতীয় বর্ষ থেকে ধীরে ধীরে সবার সঙ্গে মিশতে শুরু করে। আর এখন তো তাদের ছয়জনের বন্ধুত্বের চর্চা কলেজে সবার মুখে মুখে শোনা যায়।
তাদের ছয়জনের মধ্যে যেমন পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা হয় তেমনই জমিয়ে আড্ডাও হয় বেশ। ওদের কারো বাড়ি কলেজের কাছাকাছি নয়, কেউ আসে ট্রেনে তো কেউ বা বাসে। বাকিদের মতো তাদের বন্ধুত্বেও খুনসুটি পনা ছিল, ঝালমুড়ির ঠোঙা কাড়াকাড়ি, ক্যানটিনে আড্ডা সবই হতো, তবে সবার থেকে তাদের আলাদা করে যে জিনিসটা সেটা হলো তাদের একে অপরের প্রতি প্রান দেওয়া ভালোবাসা। একদিন কথায় কথায় নির্মলা বললো সে নাকি কোনোদিন নতুন মতিঝিল যায়নি, সোশাল মিডিয়ায় অনেককে সেখানকার ছবি পোস্ট করতে দেখেছে কিন্তু চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ এখোনো হয়ে ওঠেনি। সেই সময় তো সবাই স্বাভাবিক কথাবার্তা বলে উঠে গেল সেখান থেকে কিন্তু নির্মলা জানে না পরে বাকি বন্ধুরা মিলে নির্মলাকে নতুন মতিঝিল নিয়ে যাবার পরিকল্পনা করে নিয়েছে। পরদিন কলেজে এসে নির্মলাকে সবাই চমকে দিলো। প্রথমেই সেবিনা বললো তাহলে রবিবার কখন বেরোবি বাড়ি থেকে? সঙ্গে সঙ্গে মৃণাল বলে উঠলো তোর সেই হলুদ পোষাক টা পড়ে আসিস, তোর গত জন্মদিনে যেটা পড়েছিলি, দারুন মানায় তোকে। নির্মলার কিছু বুঝতে পারার আগেই সুমন্ত বলে উঠলো বাড়ি ফেরার সময় যদি একটু দেরি হয়ে যায় তবে মামাকে স্টেশন পর্যন্ত ডেকে নিস। নির্মলা কিছু বুঝতে না পেরে বিকৃত মুখে প্রতিক্রিয়া দিলো, মানে? তোরা কি বলছিস আমি কিছুই বুঝলাম না। সঙ্গে সঙ্গে রিমি উত্তর দিলো বা..রে.. , ম্যাডামের জন্য কষ্ট করে মতিঝিল যাবার পরিকল্পনা করলাম আর ম্যাডাম বলে কিনা কিনা কিছুই বুঝতে পারছি না।
নির্মলা 'থ'। কথাটা শুনে খুশিতে নাচবে নাকি মামা রাজি হবে কিনা সেই চিন্তা করবে ভেবে পাচ্ছিলো না। তার এরকম খুশির মধ্যেও ফ্যাকাসে মুখ দেখে কাকলি বললো তোর মামাকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমাদের, সেই চিন্তা তুই ছেড়ে দে। এবার আর খুশিতে চোখের জল থামতে পারলো না নির্মলা। রিমি, কাকলি আর সেবিনা কে জড়িয়ে ধরলো সে। পাশ থেকে মজার ছলে মৃণালের মন্তব্য - হ্যাঁ-হ্যাঁ, এত কষ্ট করে পরিকল্পনা টা আমি করলাম আর এখন ওরাই সব। ঠিক আছে তোরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদ আমি চললাম। সুমন্ত সেই সুরে সুর মিলিয়ে বললো তোর সঙ্গে আমিও আছি ভাই , চল আমরা দুজনেই কেটে পড়ি। তখন চার জন আলিঙ্গন ছেড়ে একসঙ্গে বলে উঠলো ঐ পাগলারা শোন এইদিকে। নির্মলা কান্নার স্বরে হালকা ভারী আওয়াজে বলে উঠলো এক মিনিটও শান্তি দিবি না তাই না। এই বলে মৃণালের পিঠে জোরে ব্যাগের এক আঘাত করলো। সুমন্ত নির্মলা কে রাগানোর জন্য হেসে বললো মৃনাল তোর পিঠে ধুলো ছিল সেটা ব্যাগ দিয়ে ঝেরে দিলো।
হ্যাঁ এরকমই মিষ্টি তাদের সম্পর্ক।
মৃণাল যে শুধু এবারই নির্মলার জন্য এরকম পরিকল্পনা করল তাই নয় এর আগেও করেছে। তাদের সবার মধ্যে একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক আছে ঠিকই কিন্তু ইদানীং মৃণাল নির্মলার প্রতি একটু বেশী আগ্রহ দেখাচ্ছে, একটু অন্যরকম আগ্রহ। আর সেটা সেবিনা খুব ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছিল, ব্যাপার টা সে কাকলি কে জানালো। তারপর তারা দুজনেই ঠিক করলো ব্যাপার টা নিয়ে তারা আলাদা ভাবে মৃণালের সঙ্গে কথা বলবে। এই বিষয়ে আলোচনার জন্য মতিঝিল বেড়াতে যাবার দিনই ছিল মোক্ষম সময় , আর ঠিক সেটাই করলো তারা।
গল্প- নির্মলা
বিমান চন্দ্র দাস
(দ্বিতীয় পর্ব)
সবাই একসঙ্গে নতুন মতিঝিলে প্রবেশ করলো। পুরো চত্বরটা তারা পায়ে হেঁটে ঘুরবে ঠিক করেছে। নির্দিষ্ট দূরত্ব বরাবর কয়েক জায়গায় বিশ্রামের জন্য ছাউনি করা আছে এবং তার নীচে বসার জন্য উপযুক্ত জায়গা। সেই ছাউনির তলায় তারা মাঝে মাঝে বসে জিরিয়ে নিচ্ছে। কাকলি আর সেবিনা সুযোগ খুঁজছিল কখন মৃণালকে কথা গুলো বলবে। কিছুক্ষন পরে সেই সুযোগ এসেই গেল। সুমন্ত নির্মলার ছবি তুলে দিতে ব্যস্ত ঠিক সেই সময়টাকেই কাজে লাগালো তারা। যদিও বা সেখানে রিমি উপস্থিত ছিল তবু বললো। সেবিনা শুরু করলো আচ্ছা মৃণাল একটা সত্যি কথা বলতো তুই কি নির্মলাকে ভালোবাসিস? কাকলি বলে উঠলো আমরা তোর আচরনে অনেক কিছু বুঝতে পারছি, সত্যি বলবি কিন্তু ; মিথ্যা বলে পার পাবিনা। মৃণাল নিরাশা ভরা মুখেই একটা মুচকি হাসি দিলো। রিমি পাশ থেকে বলে উঠলো কি ব্যাপার মৃণাল তলে তলে এত কিছু? মৃণাল উত্তর দিলো হ্যাঁ ভালোবাসি, নির্মলা কে ভালোবাসি, সুমন্ত কে ভালোবাসি, তোরাকে ভালোবাসি, এতে লুকানোর কিছু নেই তো। রিমি বললো এই শোন তুই কবিতা লিখিস বলে সব সময় হেঁয়ালি করে কথা বলাটা কি জরুরী। যেটা জিজ্ঞাসা করা হলো সেটার সোজাসুজি উত্তর দে না। কাকলি বললো সবাই থেমে যা অন্য ব্যাপারে আলোচনা শুরু কর, ওদের ছবি তোলা হয়ে গেছে এদিকেই আসছে। তারপর আর সেই ব্যাপারে আলোচনা করলো না কেউই। সেদিন সারাদিন খুব মজা করলো তারা। বিকেল ৩ টে নাগাদ বেড়িয়ে বাড়ির পথে রওনা দিল একসঙ্গে। তারা বাড়ি থেকে সবাই টিফিনে খাবার নিয়ে গেছিলো কারন সুমন্ত বলেছিল সেখানে যে খাবার পাওয়া যায় সেটা তার ঠিক রুচি হয়না। তবে তারা বেরোবার সময় দেখলো একটা ক্যানটিন তৈরীর কাজ চলছে। আর যেহেতু মতিঝিলের ভিতরে বাইরের খাবার খাওয়া বারন তাই তারা বেরোবার পর তাদের টিফিনে নিয়ে যাওয়া খাবার খেলো। সন্ধ্যা হয়ে এলো সবার বাড়ি পৌঁছাতে।
মৃনাল হাত মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে রাত প্রায় ১০ টার দিকে তার কবিতার ডায়েরিটা নিয়ে বসলো, আজ তারা সবাই ঘুরে এলো সেই বিষয়ে একটি কবিতা লিখতে শুরু করলো। হঠাৎ সেবিনার ফোন এলো -
মৃনাল- হ্যাঁ বল...
সেবিনা- কি করছিস?
মৃনাল- এই একটু ডায়েরিটা নিয়ে বসেছি।
সেবিনা - ও আচ্ছা, তাহলে পরে করবো নাকি?
মৃনাল- না,বলনা কোনো ব্যাপার নাই...
সেবিনা- তাহলে একটু ধর ফোনটা, কাকলি কে সঙ্গে নি, আজকে আলোচনা টা শেষ করেই ছাড়বো।
মৃনাল- উফ্ তোরাও পারিস, ছার না এসব।
সেবিনা- তুই চুপ কর, আজ এই আলোচনা শেষ করবোই।
সেবিনা কাকলি আর রিমিকে সঙ্গে নিলো, এই দেখে মৃণাল বললো সুমন্ত কেন বাকি থাকে ওকেও নিয়ে নে। সঙ্গে সঙ্গে রিমি ঠিক সেটাই করলো। প্রথমে সুমন্তকে পুরো ব্যাপার টা বুঝিয়ে বলা হলো, তার পর কাকলি বললো এবার শুরু কর মৃণাল....
মৃণাল শুরু করার আগে বললো তোদের কাছে অনুরোধ এই কথাটা নির্মলার কানে না পৌঁছায়। তোরা তো জানিস যে, যে কোনো কাজে যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তার ভালো দিক আর খারাপ দিক ভাবনা চিন্তা করে তারপর পদক্ষেপ নি। এক্ষেত্রেও তার অনথ্যা করিনি।
জানিনা নিজের অজান্তেই কখন তাকে ভালোবেসে ফেলেছি তবে সেটা কোনোদিন তার সামনে প্রকাশ করবো না, তার যথেষ্ট কারনও আছে। প্রথমত, ভালোবাসার জন্য বন্ধুত্বটা নষ্ট হোক সেটা আমি চায় না। দ্বিতীয়ত, ওদের পরিবার আর আমাদের পরিবারের সামঞ্জস্যতা দূর দূরান্ত পর্যন্ত খুঁজে পাবি না। কোথায় সে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাড়িতে ছোট থেকে বড়ো হয়েছে আর কোথায় আমি.... , কোনো মিল নেই রে আর তাছাড়া কিছু দিন আগেই গল্পের ছলে জানতে পারলাম তার বাবা নাকি তার জন্য সরকারী চাকুরি করা পাত্র খুঁজছে। তাহলে তোরাই ভাব, আমি এখোনো বেকার তাছাড়া কিছুদিনের মধ্যে যদি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েও যায় তবু সেটা সরকারী চাকুরি হবে না হবে ব্যাবসা। কারন সেটাই আমার ইচ্ছা। তাই সব দিক দিয়ে ভেবে দেখলাম আমার এই ব্যাপারে না এগোনোই ভালো।
সবাই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, সুমন্ত বললো আমি তোর সঙ্গে একমত ভাই, অন্য পথে এগোতে গিয়ে বন্ধুত্বটা নষ্ট করিস না। সেবিনা বললো তাই বলে ওকে কোনোদিন জানাবিও না? এরকম ও তো হতে পারে যে ওদের ফ্যামিলি তোকে মেনে নিলো। মৃণাল একটা অবসাদে ভরা মুচকি হাসি দিয়ে বললো সেটা হলে এই পৃথিবীতে আমার থেকে বেশী খুশি কেউ হতো না। কিন্তু তোরা এটা ভালো ভাবেই জানিস যে এর নিশ্চয়তা খুবই কম আর আমি যেটা আশঙ্কা করছি তারই সম্ভাবনা বেশী তাই এই কথা গুলো এখানেই ভুলে যা, কাল কলেজ গিয়ে সবাই স্বাভাবিক আচরণ করবি যাতে নির্মলা এসবের বিন্দু মাত্র টের না পায়। রিমি বললো এই শোন, মৃণাল যখন কথা গুলো বলছিল তখন নির্মলা আমাকে ফোন করেছিলো, ওকে একবার ফোন করতে হবে আমি রাখছি। মৃণাল বললো হ্যাঁ কর তবে খুব সাবধানে। হ্যাঁ কোনো চিন্তা করিস না রিমি এই বলে ফোনটা রেখে দিলো। মৃণাল সবার উদ্দেশ্যে বললো আমিও রাখছি রে, যেই কবিতাটা শুরু করেছি সেটা শেষ করে ঘুমাবো। এবার সবাই একসঙ্গে বলে উঠলো ঠিক আছে , শুভ রাত্রি।
নির্মলা
বিমান চন্দ্র দাস
(তৃতীয় পর্ব)
পরদিন কলেজে গিয়েই মৃণাল প্রথমেই রিমিকে চুপিসারে জিজ্ঞাসা করলো - কাল রাতে আমরা সবাই ফোন রেখে দেওয়ার পর তুই নির্মলা কে ফোন করেছিলি তখন কি বলেছিলিস? রিমি উত্তর দিল, আমি বললাম মাসি ফোন করেছিলো মা আমার ফোন থেকে কথা বলছিলো তাই ব্যস্ত পেয়েছিলিস। মৃণাল সঙ্গে সঙ্গে বাহ্বা দিয়ে বললো ভালো বলেছিস। মৃণালের এই কথাটা শেষ হতে না হতেই রিমি হঠাৎ এক অদ্ভুত ধরনের ভঙ্গিমায় বললো sorry রে, আমি তোদের কোনো দিন মিথ্যা বলি না কিন্তু বলতে হলো। মৃনাল তাকে শান্তনা দিয়ে বললো sorry তো আমাকে বলা উচিত, আমার জন্য তোকে মিথ্যা বলতে হলো। রিমি আবার একটা কি বলতে গিয়ে নিজেকে থামিয়ে নিয়ে বললো বাদ দে ওসব, চল ক্লাসের সময় হয়ে গেছে।
ক্লাসে বসেই সুমন্ত মৃণালের মুখে আর মৃনাল নির্মলার মুখে এক অস্থির ভাব লক্ষ্য করলো। মৃণালের অস্থিরতার কারন তো সুমন্ত বুঝতে পারলো কিন্তু মৃণাল নির্মলার অস্থিরতার কারনটা বুঝতে পারলো না। ক্লাসের শেষে থাকতে না পেরে মৃণাল জিজ্ঞাসা করেই ফেললো, নির্মলা তোর কি কিছু হয়েছে? নির্মলা হঠাৎ অন্যমনস্কতা থেকে তড়িঘড়ি বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করে স্বাভাবিক ভাবেই বললো কই নাতো , কি হবে? মৃণাল বললো তোর হাব ভাব কেমন লাগছে। অন্যান্য দিনের মতো স্বতস্ফূর্ত লাগছে না। নির্মলা কথাটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে বললো ও কিছু না রে, কাল রাতে ফোনে কথা বলতে বলতে বাড়ির লোকের সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে তাই আর কি। ছাড়তো ওসব, কথা কাল মতিঝিলে তুই কতগুলো ছবি তুলেছিলিস কই দ্যাখা দেখি। প্রত্যুত্তরে মৃনাল বললো হ্যাঁ দেখাচ্ছি , ততক্ষণ তোর গুলোও দেখি, তোর ফোনটা দে আমাকে । এই বলে তারা সবাই একে অপরের ফোন নিয়ে ছবি দেখতে থাকলো। তার মধ্যেই হঠাৎ করে সেবিনা বলে উঠলো কাকলি তোর দাদার বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে? কাকলি উত্তরে বললো হ্যাঁ রে, কিছুদিনের মধ্যেই নেমন্তন্ন পেয়ে যাবি। পাশ থেকে মুচকি হেসে সুমন্তর মন্তব্য নেমন্তন্নের দরকার নেই এমনি চলে যাবো। এই কথা শুনে অনেক্ষন পর সবার মুখে হাসি দেখা গেলো।
রীতিমতো কিছুদিনের মধ্যেই সবার বাড়ি নিমন্ত্রণ পত্র পৌঁছে গেলো। কারো কোনো সমস্যা ছিল না তবে নির্মলা আর সেবিনাকে নিয়ে চিন্তিত ছিল সবাই। বাইরে রাত কাটাতে হবে শুনে হয়তো আসতেই দেবে না ওদের বাড়ি থেকে। কিন্তু কাকলিও সেই ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছে। কাকলি নিজে নয় তার দাদাকে দিয়ে ওদের দুজনের বাড়িতে ফোন করিয়ে রাজি করালো। তাদের বাড়ি থেকে কোনো আপত্তি আসার আগেই সমস্ত ব্যবস্থাপনার কথা জানিয়ে দেয় কাকলির দাদা। তাদের জন্য একটি আলাদা বাড়িতে আলাদা ঘরে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে, কোনো অসুবিধা হবে না, এসব কাকুতি মিনুতি করার পর দুজনের পরিবারই রাজী হয়।
সময়মতো সবাই বিয়ের বৌভাতের দিন সকাল এগারোটায় কাকলির বাড়িতে হাজির। সবাইকে দেখে কাকলির মনে কি আনন্দ। তারা ছয়জন এক জায়গায় হতেই একটা হই-হট্টগোল বেঁধে গেল, চেঁচামেচি, নাচানাচি, হাঁসাহাঁসি পুরো বাড়ি মাথায় করে তুললো তারা। সবার নজর তাদের দিকেই, সবার মনে জিজ্ঞাসার ভাব ছেলেমেয়ে গুলো কে? কাকলির মা তো বলেই দিলো এতক্ষণে বাড়িতে বিয়ে বিয়ে মানাচ্ছে। কাকলির দাদা সুমন্তকে আগে থেকেই চিনতো ; একটি ঘরের দিকে ইশারা করে বললো আয় ভাই তোরা সবাই এঘরে এসে বোস। কাকলি বললো চল সবাই হাত-মুখ ধুয়ে নে তার পর জমিয়ে মজা হবে। পাশে থেকে কাকলির বাবার মন্তব্য এতো দূর থেকে সবাই এলো আগে কিছু খেতে দে তার পর মজা। সেবিনা বললো আসতে আসতেই আমাদের এতো খাতির ভাবায় যায় না! কাকলির হাসতে হাসতে জবাব এলো তোরা কার বন্ধু দেখতে হবে তো। নির্মলা বললো হ্যাঁ জানি এবাড়ির মহারানীর। রিমি হালকা হেসে নির্মলার কথাটায় আরো একটা বিশেষণ যোগ করে দিলো, শুধু মহারানী নয় রে আদুরে মহারানী। এর পর সবাই হাত-মুখ ধুয়ে এসে ঘরে বসতেই সবার জন্য প্লেটে মিষ্টি, দই, পাঁপড় ভাজা আর গ্লাসে সরবত নিয়ে উপস্থিত এক বালিকা। মৃনাল কাকলি কে জিজ্ঞাসা করলো তোর কাকুর মেয়ে নাকি? কাকলির উত্তরে সবাই জানতে পারলো বালিকা টি কাকলির ছাত্রী, ওদের বাড়িতেই তাদের পাঁচজনের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নির্মলা তাকে নাম জিজ্ঞাসা করায় জানতে পারলো তার নাম মীনাক্ষী তবে সবাই মিনু বলে ডাকে। যেহেতু সেবিনা মিষ্টি খায় না তাই সেই ভাগ টা গিয়ে পড়লো মিনুর কপালে। প্রথমে নিতে একটু ইতস্ততঃ বোধ করলেও পরে কাকলির সায় পেয়ে সে তুলে নেয়। এই দিকে মৃনাল মিষ্টি মুখে পুরেই জিজ্ঞাসা করলো কোন ক্লাসে পড়ো মিনু উত্তর এলো অষ্টম শ্রেণীতে। যেহেতু নিজে বাংলা সাম্মানিকের ছাত্র তাই উত্তর টা বাংলায় পেয়ে খুব খুশি হলো মৃণাল। সচরাচর সবাই কে eight -এ বলতে শোনা যায়, অষ্টম কেউ বলে না।
ইতিমধ্যে কাকলিকে কে একজন ডেকে নিয়ে গেলো। কাকলির দাদা সেই ঘরের দরজার কাছ থেকেই তারাকে বলে গেল কিছুক্ষনের মধ্যে দুপুরের খাওয়ানো শুরু হয়ে যাবে তারা যেন সময় মতো খেয়ে নেয়। সারাদিন খুব মজা করলো তারা। সন্ধ্যা হতেই আত্মীয়দের ভির বাড়তে লাগলো । ততক্ষণে তারাও নতুন পোষাক পড়ে তৈরী হয়ে নিয়েছে। কাকলি তার অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো তাদের। তার পর জোর কদমে ছবি তোলায় পাল্লা দিতে থাকলো সবাই। আর বাইরে চলছে হিন্দি গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুর্দান্ত নাচ। ছবি তোলায় তারাও কম যায়না, কাকলির দাদা বউদির কাছে স্টেজে উঠে সবাই একে একে ছবি তুলতে শুরু করলো। ঠিক তখনই রিমির চোখ মৃণালের দিকে ; সে নির্মলার দিকে একদৃষ্টে ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে আছে।
গল্প - নির্মলা
বিমান চন্দ্র দাস
চতুর্থ পর্ব
রাত তখন ১ টা বাজে অনেক আত্মীয় খাওয়া দাওয়া সেরে ইতিমধ্যে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে, তাই বিয়ে বাড়ি অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে। আমাদের চোখেও ঘুম নামক রাত টি কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসছে, তা কাকলী বুঝতে পেরে বললো একটু অপেক্ষা কর বাবাকে বলছি তোরাকে রেখে আসছে। মৃণাল বললো না না তার দরকার নেই মিনু আছে তো, ওর সঙ্গে চলে যাবো আমরা। রিমি জিজ্ঞাসা করলো কতক্ষণ লাগবে যেতে? কাকলি উত্তর দিলো তিন থেকে চার মিনিট। প্রত্তুতরে সেবিনা বললো তাহলে আমার চলে যাচ্ছি আর কাউকে পাঠাতে হবে না।
রাস্তার এক মোড়ে এত রাতে কয়েকজনের মিশ্র কন্ঠে গল্পের শব্দ এলো, একটু এগোতেই দেখে চার জন লোক এক গাছতলায় বসে মদ্যপান করছে। নির্মলা বলে উঠলো এই তো দেশের রোগ, এত রাতে কি এদের চোখে ঘুম থাকে না? বাড়ির লোকও কি কিছু বলে না এদের ? সেবিনা বললো এদের জন্যই তো আমাদের দেশে মেয়েরা সন্ধ্যা লাগলেই বাড়ির বাইরে বেরোতে ভয় পায়। মিনু ভয়ে ঢোক গিলে বলে উঠলো আমার খুব ভয় করছে। সুমন্ত বললো ধুর পাগলি ভয় কিসের, ওরা তো চার জন আর আমরা ছয় জন, কিছু বলতে এলেই সিনেমার নায়কদের মতো মেরে উড়িয়ে দিবো। এই ভাবে মিনুকে শান্তনা দিলো সুমন্ত। তার মধ্যেই রিমি বললো আমরা সবাই কে হাত লাগাতেই হবে না মৃণাল যা ক্যরাটে জানে তাতে ও একাই যথেষ্ট। নির্মলা অবাক হয়ে বলে উঠলো তাই নাকি মৃণাল, আমি জানতাম না তো! মৃণাল বললো হ্যাঁ ওই একটু আধটু আর কি। মৃণালের কথা শেষ হতে না হতেই সেবিনা বললো না রে একটু আধটু নয়, ও দারুন ক্যারাটে জানে, আমি ওর ফোনে ভিডিও রেকর্ডিং দেখেছি। এই শুনে নির্মলা বললো তোর মধ্যে আর কি কি প্রতিভা আছে একদিন ফর্দ বানিয়ে দিস তো। কবিতা লিখিস, গল্প লিখিস, ক্যারাটে জানিস আবার ছেলে হয়ে সব রান্নাও জানিস! উফ্ , সত্যি ভাবা যায় না। এই সব গল্প করতে করতেই মিনুদের বাড়ি পৌঁছে গেলো তারা।
দরজা খুলতেই দেখে এক বৃদ্ধ, অবশ্য বৃদ্ধ বলা ভুল হবে কারন বয়স একটু বেশী থাকলেও দেখে বোঝার উপায় নেই, এমনই সুঠাম দেহ তার। মৃনাল বললো নমস্কার আমরা কাকলির বন্ধু। সেই সুঠাম দেহ বিশিষ্ট ব্যক্তিটি উত্তর দিলো হ্যাঁ এসো এসো তোমাদের জন্যই বসে আছি, আমি মিনুর দাদু। মিনু কে নির্দেশ দিলো তার দাদু, 'মিনু যা বাথরুম টা দেখিয়ে দে, ওরা হাত-মুখ ধুয়ে নিক। ' যেমনি বলা তেমনি কাজ। তারা হাত-মুখ ধুয়ে আসতেই মিনুর দাদু তাদের ঘর দেখিয়ে দিলো। পাশাপাশি দুটি ঘরে তাদের জন্য আগে থেকেই খুব সুন্দর ভাবে ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। নির্মলা মিনু কে তাদের সঙ্গে ঘুমোতে বললো। তাদের ঘুমোতে রাত প্রায় দুটো পেরিয়ে যায়।
সকালে সবাই উঠে একে একে ফ্রেশ হয়ে আসতেই দেখা যায় বারান্দায় সবার জন্য চেয়ার সাজিয়ে রাখা আছে আর পাশে একটা চেয়ারে মিনুর দাদু বসে। সবাই এসে বসা মাত্র মিনু আর এক বৃদ্ধ মহিলা চা বিস্কুট নিয়ে এলো। পরোক্ষনেই জানা গেল উনি মিনুর ঠাম্মি। মিনুর মা- বাবা গেছে ব্যাঙ্গালোর ডাক্তার দেখাতে। দিন তিনেকের মধ্যেই ফিরবে বলে জানালেন দাদু। আর মিনুর এক দিদি আছে হোস্টেলে থাকে, দেয়ালের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখালো -এই তার ছবি। এইভাবে দাদুর সঙ্গে চললো কিছুক্ষন গল্প। জানা গেল দাদু ভারতীয় সেনাবাহিনী তে থেকে ১৩ বছর দেশের সেবা করেছেন। এটা শোনার পর মৃণাল বুঝতে পারলো ওনার দেহের গঠনের আসল রহস্য। সকাল প্রায় আটটা নাগাদ মিনু দের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পৌঁছায় কাকলি দের বাড়ি আর সেখান থেকে প্রায় ন'টা নাগাদ বেড়িয়ে পরে বাড়ির পথে। পরের দিন থেকে আবার কলেজ আর পড়াশোনা। তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার দিন কাছিয়ে আসছে, তাই দিন দিন পড়ার চাপ ও বাড়ছে সবার তবুও দু-এক দিন পর পর সবাই ২০-২৫ মিনিট করে কনফারেন্স কল-এর এর জন্য সময় বের করে নেয় তারা।
গল্প- নির্মলা
বিমান চন্দ্র দাস
পঞ্চম পর্ব
মৃণাল বেশ কিছুদিন ধরে নির্মলার মধ্যে একটা অস্বস্তি বোধ লক্ষ্য করছিল, যটা দিন দিন বেড়েই চলেছে ।একদিন কলেজে আলাদা ভাবে তাকে জিজ্ঞেস করলো মৃণাল, আচ্ছা তোর কি কিছু হয়েছে? কদিন থেকেই তোর মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। নির্মলা প্রত্যুত্তরে কিছু একটা বলতে গিয়েও আটকে নিলো, বললো সেরকম কিছু না রে। মৃণাল তখন আর জোর করলো না। রাতে হঠাৎ মৃণালের চঞ্চলতা বেড়ে যায়। নির্মলার ঐরূপ আচরনের কারন জানার আগ্রহ চরম সীমায় পৌঁছায়। তাই সে আর থাকতে না পেরে ফোন করলো নির্মলাকে। বেশ কিছুক্ষন ফোন বেজেই যাচ্ছে কিন্তু ধরছে না, প্রায় কেটে যাবার মুহূর্তে ফোনটা ধরলো। ভারাক্রান্ত গলায় আওয়াজ এলো হ্যাঁ বল। মৃণাল বলতে যাবে এত দেরী কেন ফোন ধরতে, কিন্তু বলতে গিয়ে থেমে গেল সে। পরিবর্তে জিজ্ঞাসা করলো তুই কাঁদছিলি? একথা শুনে নির্মলা আবার অঝোরে কাঁদতে লাগলো। কি হয়েছে জানতে চাইবে নাকি তাকে শান্তনা দিবে বুঝে উঠতে পারছিলো না মৃণাল। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলো দুজনেই। নির্মলা বুঝতে পারলো তার কান্না শুনে মৃণালের ও গলার আওয়াজ টা ভারী হয়ে এসেছে। নির্মলা বললো সেরকম কিছু হয়নি রে এর জন্য আবার তুই কাঁদছিস কেন? তার জবাবে মৃনাল বললো হ্যাঁ সত্যি তো সেরকম কিছুই তো হয়নি সেই জন্য তখন থেকে তোর কান্না থামছে না। সেরকম কিছু হয়েছে নাকি সেরকম কিছু হয়নি সেটা বলবি তাহলে তো বুঝবো। নির্মলাও আর না বলে থাকতে পারলো না। বলতে শুরু করলো সে, - দ্বিতীয় বর্ষের পর থেকেই বাড়ি থেকে মাঝে মাঝে ফোন করে জানাতো, বিয়ের জন্য ভালো পাত্রের খোঁজ এসেছে। কবে বলে ছেলে এই চাকরি করে কবে বলে ওই চাকরি করে। এসবের জন্য আমি বিরক্ত হয়ে যেতাম। একদিন রাগ করে বাবাকে বলেছিলাম ঠিক আছে আমি আর পড়াশোনা করবো না, আমি কালই চলে আসছি দিয়ে দাও আমার বিয়ে। সেই ঘটনার পর কিছুদিন এই সব কান্ড-কারখানা বন্ধ ছিলো। বাড়ি থেকে ফোন আসলেও বিয়ের জন্য কিছু বলতো না। কিন্তু কাল মা যেই কথা গুলো ফোনে বললো সেগুলো শোনার পর আমার কিছু ভালো লাগছে না রে। এই কথাটা বলতে বলতেই নির্মলার চোখ দুটো আবার কান্নায় ভরে উঠলো। মৃনাল আবার শান্ত করলো তাকে। তার মা এমন কি কথা বলেছে জানতে চাইলো মৃনাল। নির্মলা আবার বলতে শুরু করলো, বললো তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার পরই নাকি আমাকে ভাগলপুর নিয়ে চলে যাবে, আমি আর তোদের সঙ্গে থাকতে পারবো না রে। কথাটা বলা মাত্র আবার অঝোরে কাঁদতে লাগলো নির্মলা। এই বারে মৃণালের মুখ থেকেও কোনো কথা বেরোলোনা। কিছুক্ষন পর কাঁদতে কাঁদতেই পুনরায় বলা শুরু করলো নির্মলা, মা বলছিলো বাবা নাকি বাড়িতে খুব বকাবকি করেছে। বলেছে এতদিন কিছু বলিনি কিন্তু আর না এবার যে সমন্ধ টা এসেছে এরকম আর কোনোদিন পাবো না তাই তোমার মেয়েকে বলো ফাইনাল পরীক্ষার পরই বাড়ি চলে আসতে। আর মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতে হবে না, যদি পড়ার ইচ্ছা থাকে তাহলে বিয়ের পর ঐ বাড়ি থেকে পড়বে। তারা তো বলেছে বিয়ের পর পড়াতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। এতো কিছু শোনার পরও এখনও কিছু বলছে না মৃণাল, তবে নির্মলা বুঝতে পারছে যে সেও কাঁদছে। নির্মলা আরো বলতে থাকলো, তোকে এগুলো কলেজে বলিনি বলতে শুরু করলে কান্না থামাতে পারতাম না। এই রকম অবস্থাতেও আমি কিভাবে সবার সামনে এতো হাসি-খুশি থাকি আমি জানি। কথা বলতে বলতেই নির্মলা বলে উঠলো তুই লাইনে আছিস তো? মৃণালের দিক থেকে উত্তর এলো হ্যাঁ। আসলে ফাইনাল পরীক্ষার পর তারা আর একসঙ্গে থাকবে না একথা শুনে দিশেহারা হয়ে গেছে মৃণাল, কি বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারছিলো না সে। হঠাৎ করে নির্মলা বলে উঠলো, দেখেছিস কি পাগলি আমি, তখন থেকে তোর পড়াশোনা নষ্ট করে বকবক করেই যাচ্ছি। এবার মৃনালের মুখ ফুটলো, আরে না না, তুই বল আমি ঠিক পরে পড়ে নিবো। তারপর সে মনে মনে বিড়বিড় করে বললো আমি তো চাই তুই সারাজীবন আমাকেই সবকিছু বল, কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। নির্মলা জিজ্ঞাসা করলো কিছু বললি? মৃণাল বললো হ্যাঁ, বললাম যে বন্ধুদের ই যদি এসব না বলিস তো কাকে বলবি। নির্মলা অবাক হয়ে বললো বন্ধু! শুধু বন্ধু! তুই আমাকে শুধু বন্ধু ভাবিস? একথা শুনে মৃণাল হতবাক। সে বুঝে উঠতে পারছিলো না নির্মলা কি বলতে চাইছে। তার পরেই নির্মলা আবার বললো তুই আমাকে শুধু বন্ধু ভাবিস? আমি তো ভাবতাম সবার থেকে প্রিয় বন্ধু ভাবিস। একথা শুনে একটু স্বস্তি পেলো মৃণাল। সে তো এক মুহূর্তের জন্য ভেবে নিয়েছিলো নির্মলা হয়তো তার সব মনের কথা জেনে গেছে। এর পর মৃণাল উত্তর দিল শুধু প্রিয় বন্ধু নয় রে, তুই যে আমার কে সেটা তুই নিজেও জানিস না। নির্মলা অবাক হয়ে বললো মানে? পরোক্ষনেই মৃণাল বলে উঠলো আমাদের বন্ধুত্বটা প্রিয় বন্ধুর থেকেও বেশি কিছু। যেই সম্পর্কের এখোনো কোনো নামকরন হয়নি এই পৃথিবীতে। হ্যাঁ আমরা বন্ধু ঠিকই, তবে তার মধ্যেও নাম না জানা এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক লুকিয়ে আছে আমাদের মধ্যে। নির্মলা বললো হ্যাঁ ঠিক বলেছিস, তাই হয়তো আজ আমার এই ঘটনা গুলো তোকেই বললাম।
যাই হোক, অনেক্ষন কথা হলো এবার ফোন রাখছি। মৃনাল বললো হ্যাঁ রাখ তবে কথা দে কাল কলেজ আসা পর্যন্ত একবারও কাঁদবিনা। নির্মলা বললো আর যদি কাঁদি? প্রত্তুতরে মৃণাল বললো যদি কাঁদিস তাহলে কাল কলেজে এসে আবার তোকে মেরে কাঁদাবো। একথা টা শুনে এতো মন খারাপের মধ্যেও নির্মলা একটু হেঁসে বললো ঠিক আছে কাঁদবোনা। এই বলে ফোনটা রাখলো দুজনেই। ফোন রাখার শেষ মুহূর্তে নির্মলা কে একটু হাসাতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মৃণাল।
গল্প- নির্মলা
বিমান চন্দ্র দাস
ষষ্ঠ পর্ব
সব কিছু স্বাভাবিক চলছিল। হাসি-কান্না, রাগারাগি, মজা, আড্ডা, সুখ-দুঃখ সব মিলিয়ে ভালোই কাটছিল সবার। তবে তার মধ্যে মৃণাল আর নির্মলার সম্পর্কটা গভীর থেকে আরো গভীরে যাচ্ছিলো। মৃণাল শত চেষ্টার পরও নির্মলার থেকে দূরে থাকতে পারছিল না। আর নির্মলাও দিন দিন মৃণালের কাছাকাছি আসতে শুরু করেছিল। সেদিন ছিল কলেজের বসন্ত উৎসব, হলুদ শাড়ী পরিহিতা কপালে টিপ ও দুই গালে ও কপালের টিপের পাশে আলতো করে তিরঙ্গাকারে রঙ্ লাগানো। এই রূপ মোহমাখা রূপবতী কন্যাটির দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না মৃণাল। সেই কন্যাটি আর কেউ না নির্মলা নিজেই। ঠিক যেন স্বর্গ থেকে আগত অপ্সরা মনে হচ্ছিল। পাশ থেকে সুমন্ত মৃণালের কানের কাছাকাছি তার মুখটা নিয়ে গিয়ে বললো এই ভাবে কি দেখছো বৎস? একটু অন্য দিকেও ঘুরে তাকাও। মৃণাল বললো দেখতে দে রে, আর যে এই দিনটা ফিরে পাবো না, তাই স্মৃতি গুলোই মনে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকবো। কথাটা শুনে সুমন্তর মনটা যেন কেমন হয়ে গেল, সে সত্যি এটা ভাবেনি যে এটাই তাদের কলেজ জীবনের শেষ বসন্ত উৎসব। সেবিনা ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিল, সে সুমন্তর কাছে এসে বললো কিরে আজকের দিনে তোকে হঠাৎ মনমরা দেখাচ্ছে কেন? সুমন্ত বললো তুই কি ভেবছিস এটাই আমাদের কলেজ জীবনের শেষ বসন্ত উৎসব। সেবিনা বললো হ্যাঁ জানি, বাড়িতে এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি, ভাবতে ভবতে চোখের জলও বেরিয়েছে কয়েক ফোটা, কিন্তু এই মুহূর্তে সেগুলো ভেবে আজকের দিনটা বৃথা যেতে দিবো না। এমন ভাবে উপভোগ কর যাতে এই দিনটা সারাজীবন স্মৃতির পাতায় উজ্জ্বল হয়ে ভেসে ওঠে। পাশ থেকে নির্মলা শুনতে পেলো কথাটা। এগিয়ে এসে সেবিনার কথায় সেও সহমত জানালো। তার পর সবাই মত্ত হয়ে উঠলো রঙের খেলায়। কারো গালে রঙ, কারো কপালে রঙ তো কারো আবার মনে রঙ। হ্যাঁ মৃনালের মনে এতো রঙ জমেছে যে তার একবার ইচ্ছা হলো নির্মলা কে পাশে ডেকে পরিনীতা সিনেমার বাবাই দার মতো তার সিঁথিতে এক মুঠো আবির ভরে দিবে, কিন্তু যাই হোক পরক্ষোনেই নিজেকে সংযত করলো সে। সবাই সবাই কে রঙে রাঙিয়ে দিচ্ছে তার মধ্যেই কাকলি মৃণালের কাছে এসে বললো বল কি হয়েছে? মৃণাল কিছু বুঝতে না পেরে বললো কই কি হয়েছে! কাকলি মুচকি হেসে বললো তোর আবিরের হাতের মুঠোর কাপুনি নির্মলার দিকে তাকিয়ে তোর চোখের মধ্যে একটা ভয়ের আভাস এগুলোই প্রমান করে দিচ্ছে তুই ওকে নিয়েই ভাবছিস। মৃণাল প্রত্তুতরে বললো ও কিছু না রে, কয়েক সেকেন্ডের জন্য বাবাই দা হবার শখ জেগেছিল মনে তারপর নিজেকে সামলে নিলাম। কাকলি ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিমায় বলে উঠলো ও লে লে লে তাই নাকি ছেলের কি শখ। মৃণাল তাকে চুপ করতে বললো, তোকে বললাম বলে তুই আবার হাটে হাঁড়ি ভাঙ্গিস না। নির্মলার দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বললো ঐ দ্যাখ বেশী দূরে নাই শুনতে পাবে। ইতিমধ্যে রিমি আর সেবিনা তাদের কথোপকথনের মধ্যে হাজির। কাকলি বললো সে শুনতে পাক তবু তোর ইচ্ছা পূরণ করবোই। রিমি বললো কিসের ইচ্ছা রে ? কাকলি হাসতে হাসতে বললো এখানে এখন পরিনীতা সিনেমার বাবাই দার মেহুলের সিঁথিতে আবির ভরে দেওয়ার দৃশ্য টি অভিনয় করে দেখানো হবে, তবে চরিত্রের পরিবর্তন হবে, আমি হবো বাবাই দা আর মৃণাল হবে মেহুল। একথা শুনে সেবিনা আর রিমির সে কি হাসি। এত কিছুর মধ্যেও মৃণালের নির্মলার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকানো একটুও কমলো না। সত্যি তারা দিনটিকে এমনভাবে উপভোগ করলো সারা জীবন স্বরণীয় হয়ে থাকবে। সেদিন বাড়ি ফেরার পথে সবার মন খারাপ কারন এই রকম দিন আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। কিন্তু পরীক্ষার পড়ার চাপে সব যেন কেমন এলো মেলো হয়ে যাচ্ছে । পরীক্ষা আরম্ভ হয়ে গেছে তাই কিছু দিন থেকে ফোনে কারো সঙ্গে সেরকম ভাবে কথা হয়ে ওঠে না। যেটুকু হয় তা পড়ার বিষয়েই হয়। অবশেষে সেই দিনটি এসে উপস্থিত হতে চলেছে যেই দিনের আশা কোনো ছাত্র ছাত্রী -ই করে না । কিন্তু বিধির বিধান তো আর কেউ পাল্টাতে পারে না ।
গল্প- নির্মলা
বিমান চন্দ্র দাস
সপ্তম পর্ব
আর একটাই পরীক্ষা বাকি ছিল, তার পর হয়তো কে কোথায় হারিয়ে যাবে ঠিক নেই। কয়েকদিন থেকেই কারো মনে স্ফূর্তি নেই, সবার মনমরা। নির্মলা তো কেঁদেই ফেলে যখন-তখন। যখনই তার মনে আসে পরীক্ষার পর তাকে চলে যেতে হবে ভাগলপুর তখনই সে আর চোখের জল থামিয়ে রাখতে পারে না। আসলে তারা এমন একটা বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছে যে কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে চায় না। অগত্যা সবাই মুখোমুখি হলো সেই দিনটার। হ্যাঁ আজ শেষ পরীক্ষা। শুধু তারা ছয়জনই নয় সকল ছাত্রছাত্রী রা নিজ নিজ পরীক্ষা কক্ষ থেকে বেড়িয়ে নিজ নিজ প্রিয় মানুষটির কাছে হাজির। সবার মুখে পরীক্ষা শেষ হবার স্বস্তির থেকে বন্ধু দের থেকে দূর হবার কষ্টটায় বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেকেই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে, এই দৃশ্য যে কতটা করুন সেটা শুধুমাত্র তারাই বুঝতে পারবে যারা বাস্তবে এই ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্না, আলিঙ্গন, তার মাঝেই কিছু সেলফি নেওয়া, সত্যি অদ্ভুত ও কষ্টকর অভিজ্ঞতা এটি।সেবিনা বললো চল আমরাও একটা গ্রুপ সেলফি নি, কথা মতো সঙ্গে সঙ্গে কাজও সম্পন্ন হলো। কারো স্বাভাবিক কন্ঠে কথা বেরোচ্ছিলো না, সবার গলায় কান্নার আভাস। সত্যি এই স্কুল আর কলেজ জীবনটা বড়োই বিচিত্র। ছেলেবেলায় এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে না হয় সেই জন্য কাঁদতে হতো, আর বড়ো হয়ে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বেড়িয়ে যেতে হচ্ছে তাই কাঁদতে হচ্ছে।
সেদিন বাড়ি এসেও মন ভালো নেই কারো। রাত ১০.৩০ নাগাদ কনফারেন্স কল করলো রিমি, সেদিন প্রায় ৩ ঘন্টার ও বেশি সময় কথা হয়েছিল তাদের। কথার মাঝে কাকলি রেগে গিয়ে বললো সেই কলেজ থেকে তোরা এমন নাকি কান্না শুরু করেছিস মনে হচ্ছে আমাদের আর কোনো দিন কথা হবে না, আমরা তো হারিয়ে যাচ্ছি না, সবাই সংস্পর্শে থাকবো। তোরা সবাই যদি একই রকম ভাবে মন খারাপ করে বসে থাকিস তাহলে কি ভালো লাগে বলতো? নির্মলা বললো ঠিক বলেছিস, তাহলে আমি তোদের মনটা একটু ভালো করে দি কেমন। কাকলি জিজ্ঞাসা করলো কিভাবে। নির্মলা বললো একটা খুশির খবর আছে, আমরা সবাই কাঠগোলা বাগান বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছি। একথা শুনে সবার গলার আওয়াজ টা পাল্টে গেল। নির্মলা আরো বলতে থাকলো, আমি বিকেলে বাড়িতে ফোন করেছিলাম তার পর বলি যে আমি এখন কয়েকদিন বাড়ি যাচ্ছি না, সামনে ২৭ তারিখে আমার জন্মদিন টা এখানেই বন্ধুদের সঙ্গে কাটাতে চায়। আর সেকথায় বাড়ি থেকে রাজি হয়েছে। রিমি বললো আরে তাই তো আজ তো ২১ তারিখ হয়ে গেল আর ৬ দিন পরেই তো তোর জন্মদিন। একথা শুনে একটু হলেও সবার মন ভালো হলো।
এই কটা দিন কোনো রকমে দিন কাটিয়ে এলো সেই দিন । সবাই সকাল সকাল তৈরী হয়ে বেড়িয়ে পড়লো লালবাগের সেই ঐতিহাসিক স্থানটির দিকে, যেখানে শুধু মুর্শিদাবাদ নয় লুকিয়ে আছে পুরো ভারতবর্ষের তথা বিশ্বের অজানা ইতিহাস ।
গল্প- নির্মলা
বিমান চন্দ্র দাস
অষ্টম পর্ব
শুভ জন্মদিনের বার্তার সঙ্গে ঘুম ভাঙ্গলো নির্মলার। সেদিন সবাই সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়েছিলো লালবাগের উদ্দেশ্যে। প্রায় ১০ টা নাগাদ হাজির হলো কাঠগোলা বাগান বাড়ির সামনে, ততক্ষণে কাকলি আর সুমন্ত সেখানে এসে অপেক্ষা করছিল। সবাই এক জায়গায় হতেই একটা খুশির আমেজ।
রাস্তার পাশেই একটি সিংহদ্বার তার সামনে অনেক মানুষের সমাগম। সেই দ্বারের ভেতরে প্রবেশ করতেই দুই ধারে অগনিত গাছ আর তার মধ্যেই কিছু ঐতিহাসিক স্তম্ভ আর কিছু অশ্বারোহী মূর্তি। মধ্যের সরু রাস্তা ধরে কয়েক পা এগোতেই দেখা গেল টিকিট কাউন্টার। সেখানে টিকিট কেটে এবার আসল জায়গায় প্রবেশ করলো তারা। কাকলি বললো একটা গাইড নিলে ভালো হতো। মৃণাল তার উত্তরে বললো গাইডের দরকার হবে না, চল আমি সব বুঝিয়ে বলছি। সুমন্ত মজার ছলে বলে উঠলো হ্যাঁ চল আজ আমাদের বাংলার শিক্ষক মহাশয় ইতিহাস পড়াবেন। হাসি-ঠাট্টা করতে করতেই এগোচ্ছে তারা। মুখ্য বাড়িটি পৌঁছাবার আগেই বাম দিকে গুপ্ত সুড়ঙ্গ আর ডান দিকে চিড়িয়াখানা। মৃণাল বললো এগুলো পড়ে দেখবো আগে প্রধান যে বাড়িটা সেটা দেখে নি। সেই কথামতো এগিয়ে গেল তারা। এবার কাঠগোলা বাগান বাড়ির সামনে উপস্থিত হলো। কি সুন্দর দৃশ্য, বাড়িটির সামনেই একটা বিশাল পুকুর। পুকুরটির চারকোনে ও বাড়ির সামনে এবং তার বিবরীত পাড়ে সুন্দর ভাবে মোট ছয়টি ঘাট বাঁধানো। বাড়ির সামনের ঘাটটিতে একটি সুন্দর ফোয়ারা। সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতেই পুকুরে দেখাগেলো রঙ - বেরঙের মাছ জলে খেলা করছে। হঠাৎ করেই মৃণালের গলার আওয়াজ, এই মাছ গুলো খাওয়া হয় না। আর এগুলোর মধ্যে যদি কোনো মাছ মারা যায় তাহলে তাকে কবর দেওয়া হয়। নবাবী আমল থেকেই চলে আসছে এই রীতি। কবরের স্থানটি পরে দেখতে পাবি তার আগে চল বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করি। ভেতরে প্রবেশ করতেই সেবিনা বললো জিনিস গুলো কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। মৃণাল জবাব দিলো, না চেনার কিছু নেই এখানে অনেক সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে। সেবিনা একটু উঁচু কন্ঠে আগ্রহের সঙ্গে বলে উঠলো হ্যাঁ মনে পড়েছে 'বলো দুগ্গা মাই কি' নামক সিনেমায় দেখেছি, এতক্ষণে সব মনে পড়ছে। মৃণাল তার কথা আবার শুরু করলো, এই ঐতিহাসিক বাড়িটির গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো হলো - কষ্টিপাথরের সিংহাসন, ১৮ ফুট উঁচু বেলজিয়াম আয়না, ৭৫ ফুট উঁচু বিনা স্তম্ভের কাঠের সিঁড়ি, মার্বেল টেবিল... ও হ্যাঁ এখানে যে মার্বেল টেবিল আছে তার সঙ্গে তাজমহলের মার্বেলের মিল পাওয়া যায়। চলতে চলতে সবাই একসঙ্গে থমকে গিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো মৃনালের দিকে। কাকলি বললো সত্যি তোকে যত দেখি ততই অবাক হয়ে যায়। নির্মলা ইয়ার্কির ছলে বললো তুই তো গাইড দের ব্যাবসা গুটিয়ে দিবি দেখছি। মৃণাল মুচকি হেসে বললো বেশি বকিস না সামনে এগিয়ে চল।
মুখ্য বাড়িটি থেকে বেড়িয়ে পূর্ব দিকে এগিয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে আঙ্গুলের ইশারায় দেখালো মৃণাল, ঐ যে ওখানে সামান্য উঁচু স্টেজের মতো আছে দেখছিস, ওটাকে জলসাঘর বা নাচমহল বলে। চল দেখে আসি। নাচমহলটির উপরে উঠে মৃনাল তার বক্তব্য চালু রাখলো, এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা নাচের আসর বসতো। ততকালীন নবাবী লোকেরা, ইংরেজ সাহেবরা ও ধনী ব্যাবসায়ী রা এখানে আসতো মনোরঞ্জনের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু নর্তকী কে নিয়ে আসা হতো এখানে। তখনকার ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় তাদের মধ্যে একজন ছিলো হীরা বাঈ। সে নাকি প্রতি সন্ধ্যায় নাচ করার জন্য ৫০০০ মুদ্রা নিতো। তার একটি বিশাল ছবি হাজারদুয়ারী তে টাঙ্গানো আছে। সেখান থেকে তারা দুই ধারে গোলাপের বাগান ছাড়িয়ে এগিয়ে চললো সামনের দিকে। একটু এগোতেই একটা ছোট স্তম্ভ লাগোয়া দুই ধারে দুটো মাছের মূর্তি দেখা গেল। মৃনাল বললো এখানেই মাছেদের কবর দেওয়া হয়। মৃণাল বললো চল এবার ঐ মন্দিরটার মধ্যে প্রবেশ করি। তারা সবাই মন্দিরের বাইরে নির্দিষ্ট স্থানে জুতো খুলে হাত-পা ধুয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। এই মন্দিরের ভেতরে মোবাইল ব্যাবহারে নিষেধাজ্ঞা আছে। তাই তারা প্রবেশ করার আগেই সুইচ অফ করে দিলো। এমনকি এই মন্দিরে প্রবেশ করার পূর্বে সবাই কে কথা বলতেও বারন করা হয়। তবে ধর্ম - বর্ণ নির্বিশেষে সকল পর্যটকদেরই এখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। সেখান থেকে বেড়িয়ে নির্মলা বললো নবাব দের বাগানবাড়ি তে মন্দির কিভাবে এলো বুঝতে পারলাম না। এটা শোনার পর মৃণাল একটানা ১০ মিনিট বক্তৃতার ন্যায় বলতে থাকলো।
মৃণাল :- আমি এই জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, দেখতে চাইছিলাম প্রথম প্রথম আমার মনে যে প্রশ্ন আসতো সেটা তোরাও ভাবিস কিনা। এই বলে পুরো ইতিহাস বলতে শুরু করলো মৃণাল, এটি নবাবদের তৈরী নয়। রাজস্থান থেকে আগত এক ব্যাবসায়ী এটি নির্মাণ করান। তিনি ছিলেন জৈন ধর্মাবলম্বী, তাই এই মন্দিরটিও জৈন মন্দির। মন্দিরটি আদিনাথ মন্দির বা পরেশনাথ মন্দির নামে পরিচিত। আদিনাথ হলো জৈন ধর্মের প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভনাথের আরেক নাম। মন্দির টি প্রথম থেকে এখানে ছিলো না ১৮৭৩ সালে তৎকালীন বাড়িটির মালিক তার মায়ের ইচ্ছা তে এটি বানান। আর এই বাগানবাড়ি টি তৈরী করান বর্তমান জিয়াগঞ্জ শ্রীপত সিং কলেজের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীপত সিং দুগরের পূর্বপুরুষ লক্ষীপত দুগর। তারা চার ভাই ছিলেন - লক্ষীপত সিং দুগর, ধনপত সিং দুগর, মহীপত সিং দুগর ও জগপত সিং দুগর। তারা এখানে ব্যাবসার সূত্রে এসেছিলেন, এখানে এসে তখনকার সব থেকে ধনী ব্যাবসায়ী জগৎ শেঠের সঙ্গে তাদের ভালো সম্পর্ক হয়। সেই সুবাদেই তৎকালীন নবাবের কাছে মাত্র ১২০০ টাকায় ২৫০ বিঘা জমি কিনে নেন। তার পরই তৈরী করান এই বাগান বাড়ি টি। সিংহদ্বার দিয়ে প্রবেশের পরে পরেই যে চারজনের অশ্বারোহী মূর্তি দেখেছিলি সেগুলো এদের ই চার ভাইয়ের। বর্তমানে লক্ষীপত সিং দুগরের দশম প্রজন্ম সঞ্জয় সিং দুগর ও সিদ্ধার্থ সিং দুগর এই প্রাসাদটির দেখাশোনা করেন। তারা বর্তমানে কলকাতায় থাকেন। আসার সময় মুখ্য বাড়িটির পিছনে যে ভগ্নাবশেষ টি দেখলি সেটা অতীতে অতিথিশালা ছিলো। এর পর তারা বাড়িটির সামনে যে পুকুর টা আছে তার বিপরীত পাড়ে এলো, সেখান থেকে বাড়িটির অসাধারণ দৃশ্য চোখে পড়লো। আহা! কি দৃশ্য মন জুড়িয়ে গেলো সবার। মৃনাল বললো চল ঐ গাছের তলায় বসে টিফিন টা বের করে খেয়ে নি তার পর সুড়ঙ্গ আর চিড়িয়াখানা টা দেখবো। খাওয়ার পর পাঁচ মিনিট পুকুর পাড়েই বসলো তারা। কেউ ছবি তুলতে ব্যস্ত, কেউ পাইচারী করতে শুরু করলো। সেই সময় রিমি নির্মলাকে ডেকে বললো, নির্মলা আমি আর মিথ্যা বলতে পারছি না, আর কতদিন লুকিয়ে রাখবো? কিছু মনে করিস না আমি তোর প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গলাম আজই ওকে সব বলে দিবো। নির্মলা রিমির মুখে হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, এরকম করিস না বন্ধু। যা বলার এখান থেকে ফেরার পর বলিস। কালই আমি ভাগলপুর চলে যাবো আবার কবে তোদের সঙ্গে দেখা হবে জানিনা, অন্তত আজকের দিনটা কারো চোখে জল দেখতে চাই না রে। মৃনাল বেশি দূরে ছিল না তাই এইসব কথোপকথন গুলোর কিছুটা তার কানে এলো। সে কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে রে রিমি? রিমি মৃণালের কন্ঠ শুনে আচমকা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বললো, ও তেমন কিছু না, পরে বলবো। নির্মলা চাইছিলো না এই কথাটা নিয়ে আলোচনা শুরু হোক তাই সে রিমি আর মৃণালের কথার মধ্যেই বলে উঠলো চল এবার চিড়িয়াখানা টা দেখি। এবার মৃণাল সেই কথা থেকে বেড়িয়ে এসে নির্মলার কথার উত্তরে বললো হ্যাঁ যাবো তার আগে চল সুড়ঙ্গ টার ব্যাপারে একটু জেনে নি। সবাই একসঙ্গে সুড়ঙ্গ টার সামনে এসে দাঁড়ালো। মৃনাল আবার আগের ভঙ্গিতেই বলতে শুরু করলো, এই সুড়ঙ্গ টি ইংরেজদের চোখে ধুলো দিয়ে লুকিয়ে ব্যাবসা করার জন্য বানানো হয়েছিলো। এই সুড়ঙ্গ টি সরাসরি চলে যায় এখান থেকে প্রায় চার কিমি দূরে জগৎ শেঠের বাড়ি। এই সূত্রে বলে রাখা ভালো জগৎ শেঠের পুরোনো এবং বড়ো বাড়িটি কিন্তু গঙ্গা নদীর তলায় তলিয়ে গেছে। আর তাই এই সুড়ঙ্গ টি সবসময় জলমগ্ন থাকে। এমনকি গঙ্গা নদীর জল বাড়লে এই সুড়ঙ্গের জলস্তর ও বারে আর কমলে কমে। এই কথা শুনে সুমন্ত আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইলো তাহলে এখন যেই জগৎ শেঠের বাড়িটি সবাই দেখতে যায় সেটা কি নকল? মৃণাল জবাব দিলো না সেটাও জগৎ শেঠেরই বাড়ি, কিন্তু যে বাড়িটা নদীর গর্ভে তলিয়ে গেছে তার তুলনায় এটি খুবই ছোট।
মৃণাল বললো সন্ধ্যা হবার আগেই সবাই কে বাড়ি পৌঁছাতে হবে চল এবার চিড়িয়াখানা টা দেখেই বেড়িয়ে পড়বো।
চিড়িয়াখানায় প্রবেশ করতে করতে মৃণাল বললো এর আগে আমি যখন এসেছিলাম তখন চিড়িয়াখানা টাও ঐ অতিথিশালার মতো ভগ্নাবশেষ হয়ে পড়েছিলো ইদানীং এটিকে ঠিক করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তাই এই ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো না। যা অনুভব করার তা নিজে চোখে দেখেই কর। তবে হ্যাঁ এটুকু জানি যে যখন চিড়িয়াখানাটা ঠিক ছিল তখন এখানে বাঘ, সিংহ বা কোনো মাংষাষী পশু রাখা হতো না। কারন রাখলে তাদের মাংস খেতে দিতে হবে, আর জৈন রা তাদের বাড়ির চৌকাঠে পর্যন্ত মাংসের স্পর্শ পড়তে দেশ না।
তবে এখন কি কি আছে সেটা ভেতরে গিয়েই বুঝতে পারবো। ভিতরে গিয়ে তারা দেখলো কি সুন্দর সুন্দর পাখি। যেসব পাখির তারা চোখে দেখা তো দূরের কথা নামও শোনেনি। বিভিন্ন দেশের পাখি আছে সেখানে, এমনকি উট পাখিও চোখে পড়লো। এছাড়াও খরগোস, বিভিন্ন মাছ, হাঁস বিভিন্ন প্রাণী ছিলো।
সেখান থেকে বেড়িয়ে সবাই ঠিক সময়ে বাড়ি পৌঁছে গেলো। রাত্রি তখন সবে ৯ টা বেজেছে, ঠিক এমন সময় মৃণালের ফোন বেজে উঠলো। বিপরীত দিকে রিমির আওয়াজ। রিমি কাঁদতে কাঁদতে বলনো মৃনাল আমাকে ক্ষমা করে দিস, তোকে আমি মিথ্যা বলেছি। মৃণাল কিছু বুঝতে না পেরে বললো এই পাগলি কি হয়েছে কাঁদছিস কেন? রিমি একটা ছোট্ট শ্বাস নিয়ে বললো নির্মলা সব জানে রে। মৃণালের মাথায় যেন পাহাড় ভেঙ্গে পড়লো। মৃণাল এবার একটু বুঝতে পারলো বললো মানে, কি বলছিস তুই? রিমি আবার কাঁদতে কাঁদতে বললো হ্যাঁ রে সব জানে নির্মলা। এমন কি তুই ফোনে যা বলিস সেইসবও জানে। তোর মনে আছে আমরা একদিন মতিঝিল থেকে এসে রাতে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলাম আর সেদিন নির্মলা আমাকে ফোনে পাইনি, ব্যস্ত বলেছিল। সেদিনই ও বুঝে গেছিলো। পরে আমাকে পরিবারের সদস্যের দিব্যি দিয়ে সব জানতে চায়, তাই অগত্যা আমাকে সব সত্যি বলতে হয়। এমনকি তার পরেও যা যা বলতিস সব তাকে বলতে হতো। কিন্তু তোকে কিছু বলতে পারতাম না কারন আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলো। আজ তা ভেঙ্গে দিয়েছি। আজ কাঠগোলা বাগানের সামনে পুকুর পাড়ে টিফিন করার সময় যখন তুই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলি কি ব্যাপার তখন এই ব্যাপারেই কথা হচ্ছিল। মৃনাল নির্বাক। কি বলবে বা কি করবে ভেবে পাচ্ছিলো না। তার মধ্যেই রিমি বলতে থাকলো, ওকে আটকা মৃণাল, কাল ই ওর ভাগলপুর চলে যাবার কথা, যেতে দিস না ওকে। আমি জানি ওই ও তোকে খুব ভালোবাসে । তোকে ছাড়া ওই ও ভালো থাকবে না আমি জানি। মৃণাল তখন আর কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলো না। তার মাথার মধ্যে তখন হাজারো চিন্তা ভির করেছে। রিমি মৃণালের অবস্থা বুঝতে পারছিলো। কিন্তু সেই মুহূর্তে কারো কিছু করার ছিলো না।
গল্প- নির্মলা
বিমান চন্দ্র দাস
অন্তিম পর্ব
সকাল তখন ৭ টা মৃণাল ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে বেড়ানোর জন্য তৈরী হচ্ছে । সে এখন দিল্লিতে, আজ গ্রামের বাড়ি ফিরছে। কারন আগামী কাল হোলি, আর গত ১২ বছরে এমন কোনো বছর যায়নি যে বসন্ত উৎসবে সে গ্রামের বাড়িতে থাকেনি। হ্যাঁ ১২ বছর। দেখতে দেখতে ১২ বছর হয়ে গেল। এই ১২ বছরে প্রতি বছরে হোলির দিন মৃণাল বাড়িতেই সময় কাটায়। দুপুরে খাবার পর ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে বেড়িয়ে পরে কলেজের উদ্দেশ্যে। কলেজের সামনে গিয়ে আনমনে কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তার পর মাথার মধ্যে এসে ভির করে পুরোনো দিনের স্মৃতি। সেগুলো ভাবতে ভাবতেই নিজের অজান্তেই কখন চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। চোখের সামনে হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রী দের রঙের উৎসবে মেতে উঠতে দেখে মনে পড়ে যায় তাদের কলেজ জীবনের কথা। তবে বেশিক্ষন সেখানে সে দাঁড়ায় না, মানুষ তাকে চিনে ফেললে সেখানে ভির জমে যেতে পারে । তার কারন সে এখন স্বনামধন্য ব্যাক্তি। একাধারে সে স্বনামধন্য ব্যাবসায়ী আবার তার পাশাপাশি স্বনামধন্য লেখকও বটে। কলেজের সামনে থেকে একটু হেঁটে গিয়ে নদীর পাড়ে বসে সে। তার পর শুরু হয় ফোন। রিমি, সেবিনা, কাকলি, সুমন্ত সবাই জানে বসন্ত উৎসবে বিষেশত হোলির দিন মৃণালের ফোন আসবেই। শুধু মাত্র কথা হতো না নির্মলার সঙ্গে। ১২ বছর আগে কাঠগোলা বাগান বাড়িতে সেই শেষ কথা আর শেষ দেখা হয়েছিল তাদের। তার পর কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই নির্মলার। এমনকি ফোন নম্বরটাও পরিবর্তন করে নিয়েছে। ভাগলপুর যাবার ২ দিন পর নির্মলা মৃনাল কে একটা হোয়াট্সঅ্যাপ বার্তায় বলেছিল ভুল করেও আমার খোঁজে কোনোদিন ভাগলপুর আসিস না, তার পর থেকে আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। নদীর পাড়ে বসে ফোন করার পর সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি ফিরে যায় মৃনাল, আর তার পর শুরু হয় ডায়েরি লিখা। এবারো তার অন্যথা হবে না। দিল্লি থেকে বাড়ি ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। তার গ্রামের বাড়িতে তার ভাই, ভাইয়ের বউ আর ৮ বছরের এক মেয়ে থাকে। মৃনাল অনেকবার বলেছে তার কলকাতার ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকতে, কিন্তু তার ভাইয়ের বক্তব্য সে গ্রামের বাড়িতেই থাকতে চায়। বর্তমানে ভারতবর্ষের 6 টা বড়ো বড়ো ব্যাবসার মালিক মৃণাল। মৃণাল অনেকটা পথ অতিক্রম করে এসেছে তাই দরজাটা এঁটে দিয়ে ঘুমোতে যাবে এমন সময় দরজার বাইরে থেকে তার ভাইয়ের ডাক শুনতে পেল। দরজা খুলতেই দেখে একটা চিঠির খাম হাতে দাঁড়িয়ে তার ভাই। খামটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো এই নে তোর নামে আজ সকালে এই চিঠি টা এসেছে । তুই আসছিস জেনে ফোন করে আর বলিনি। চিঠি টা হাতে নিয়ে বললো আচ্ছা ঠিক আছে। দরজা লাগানোর আগেই তার ভাইকে বললো নির্মলা টিউশন থেকে এলে এই চকলেট গুলো দিয়ে দিস। রাত্রে খাবার কিছুক্ষন আগে তুলে দিস তখন বসে ওর সঙ্গে গল্প করবো। এই বলে দরজাটা এঁটে দিলো। চিঠির খামটা টেবিলে রেখে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লো। রাত 8 টা নাগাদ মৃনালের ঘুম ভাঙ্গলো। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে নির্মলা ছুটে এলো মৃণালের ঘরে। এই নির্মলা হলো মৃণালের ভাইয়ের মেয়ে, নামটা মৃণালের ই দেওয়া। মৃণাল হাত মুখ ধুয়ে ঘন্টা খানেক তার ভাইজির সঙ্গে গল্পের ছলে খেলা করলো। তার পর নির্মলার মা এসে বললো দাদা রান্না হয়ে গেছে, কখন খাবেন বলবেন। মৃণাল বললো ও আচ্ছা, ভাই কোথায়? উত্তর এলো আপনি রসমালাই খুব পছন্দ করেন তাই বাজার গেছে শ্যাম ময়রার দোকান। এক্ষুনি চলে আসবে। মৃণাল বললো ঠিক আছে ভাই এলে একসঙ্গে খেয়ে নিবো।
পরদিন সকালে উঠে একটু গ্রামটা ঘুরতে বেড়োলো মৃণাল। দুপুরে খাবার পর হঠাৎ মনে পড়লো কালকের চিঠির কথা, দেখলো টেবিলের উপর যথা স্থানেই রাখা আছে সেটি। হাতে তুলে নিয়ে এপিঠ ওপিঠ উল্টে দেখলো কারো নাম লিখা নেই। তবে তার নিজের ঠিকানাটার দিকে ভালো করে দেখা মাত্র অবাক সে! এতো নির্মলার হাতের লিখা! এর পর আর কিছু না দেখেই সঙ্গে সঙ্গে চিঠি টা খুলে পড়তে শুরু করলো সে।
"জানিনা এখন আমাকে ঘৃনা করিস, নাকি আমার উপর রাগ করে আছিস, নাকি এখনো আগের মতোই ভালোবাসিস? তবে এটা ভালো করে জানি যে, প্রেমিকা নির্মলার উপর রেগে থাকলেও বন্ধু নির্মলার উপর রেগে থাকতে পারবি না।
আমি জানি তুই হোলি তে গ্রামের বাড়িতে থাকিস তাই হোলির পর দিনই আসছি আমি। পারলে রিমি কে কথাটা জানিয়ে দিস, সম্ভব হলে বাকিদের ও বলে দিস। ৪ দিন থাকবো মুর্শিদাবাদে। তাদের কে বলিস পারলে যেন দেখা করে।
ইতি -
তোদের হতভাগী নির্মলা। "
চিঠিটা পড়ার সময় মৃণালের চোখের জল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উথাল-পাথাল করতে লাগলো চোখেই। চিঠি টা পড়ার পর অনেক প্রশ্ন এসে ভির করলো মৃণালের মনে। সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটের যুগে নির্মলা চিঠি কেনো লিখলো? চিঠির শেষে সে নিজেকে হতভাগী কেন বলেছে? আর সব থেকে বড়ো প্রশ্ন হলো যোগাযোগ করলই যদি তাহলে ১২ বছর পরে কেন? এত দিন কোথায় ছিল সে? সে কেমন আছে সেটা পর্যন্ত লেখেনি চিঠিতে, তাহলে কি সে ভালো নেই? এই প্রশ্ন গুলো মনকে চঞ্চল করে তুললো মৃণালের। বিছানায় শুয়ে সেগুলোই ভাবতে থাকলো সে, কিন্তু কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না। সেদিনও প্রতি বছরের ন্যায় কলেজের সামনে গেল মৃণাল। নদীর পাড়ে বসে রিমি কে ফোন করলো, একে একে সবাই কে যুক্ত করলো রিমি। রিমি এখন বীরভূম জেলার রামপুরহাটে থাকে। স্বামী আর দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার তাদের। সেবিনা ও কাকলির অবস্থাও তাই। তবে সেবিনা থাকে বহরমপুরেই আর কাকলির বিয়ে হয়েছে নদীয়ার কৃষ্ণনগরে। আর সুমন্ত তার এক দুর সম্পর্কের আত্মীয়ের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করেছে বহরমপুরেই। আর মৃণালের জন্য শুধু মুর্শিদাবাদ নয় বা শুধু এরাজ্য নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখনো বিয়ের প্রস্তাব আসে, কিন্তু তার এক বাক্য, সে বিয়ে করবে না। ফোনে মৃনাল চিঠির কথাটা বলতেই সবাই অবাক। প্রথমে রেগে কাকলি বললো এতোদিনে মনে পড়েছে মহারানীর। কিন্তু পরোক্ষনেই কান্না নেমে এলো সবার চোখে। সবাই একসুরে বলে উঠলো কাল সূর্য পূর্ব দিকে উঠুক বা পশ্চিমে, ভূমিকম্প আসুক বা মহাপ্রলয় হোক, যেভাবেই হোক না কেন, কাল আমরা সবাই আসছি তোর বাড়ি। মৃণাল বললো ঠিক আছে। সেদিন মৃণাল অনেক কেনাকাটা করে একটু রাত করে বাড়ি ফিরলো। তার হাতে এতো বাজারের থলি দেখে তার ভাই জিজ্ঞাসা করলো, কি ব্যাপার দাদা এতো মালপত্র কিসের? মৃণাল বললো কাল আমার কয়েকজন কলেজের বন্ধু আসবে, কই নির্মলার মাকে একটু ডাকতো। একথা বলতে বলতেই নির্মলার মা সেখানে হাজির। মৃনাল তার দিকে বাজারের থলি গুলো এগিয়ে দিয়ে বললো, এই নাও কাল তোমার একটু কষ্ট বাড়িয়ে দিলাম। সেদিন রাতে মৃণালের অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম এলো না। তার মনের অবস্থা কাউকে বলতে পারছে না সে, শুধু মনের কথা গুলো কলমের রেখা দিয়ে ডায়েরির পাতাকে বলে রাখছে। পরদিন সকালে উঠেই মৃনালের ব্যস্ততা তুঙ্গে। আজ ১২ বছর পরে নির্মলার সঙ্গে দেখা হবে এই ভেবেই তার মনে জলকম্পের ন্যায় ঢেউয়ের টালমাটাল খেলা চলছে। সকাল তখন ৯ টা হবে, মৃণালের ভাইজি বাড়ির উঠোন থেকে দৌড়ে ভেতরে গিয়েই তার মাকে বলছে, মা জ্যাঠামশায়ের ঘরে যেই আন্টি গুলোর ছবি আছে সেরকমই দেখতে একটা আন্টি এসেছে। কথাটা শুনে মৃণালের বুকে যেন পাহাড় ভেঙ্গে পড়লো। এক ছুটে বাইরে এসে দেখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নির্মলা। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের চোখে চোখ রেখে তাকানো, তার পর কেউ কারো দিকে তাকিয়ে উঠতে পারলো না। সেই কয়েক সেকেন্ডের তাকানোতেই মৃণাল দেখলো নির্মলা সেই আগের নির্মলা নেই। অপ্সরার মতো দেখতে তার চেহারা আজ মলিন হয়ে এসেছে। যে মুখে সর্বদা বসন্ত ঝরা হাসি লেগে থাকতো সেই মুখে আজ হাসির চিহ্ন মাত্র নেই। সেই হাসিট যেনো কোনো এক অজানা ভুলে ঢাকা পড়ে গেছে। তার চেহারার ঔজ্জ্বলতা যেন হাজারো চিন্তার ভিরে কোথায় হারিয়ে গেছে। কোনো এক ব্যর্থতা যেন তার পিছু ধাওয়া করে বেড়াচ্ছ তাকে। সব মিলিয়ে সে আজ জরাগ্রস্ত। তবে সব থেকে যে বিষয় টা মৃণালকে অবাক করলো তা হলো নির্মলার সিঁথিতে সিঁন্দুর দেখতে পেলো না। তাহলে কি সেও মৃণালের মতোই ... নাকি ...? যাই হোক পরে সেটা জিজ্ঞেস করে নেওয়া যাবে। মৃণাল তার দিকে তাকানোর ভান করে বললো আয় ঘরে আয়। ঘরের দিকে এগিয়ে যেতেই মৃনালের ভাইজি অর্থাৎ ছোট নির্মলার দিকে চোখ পড়লো তার। ঘরে বসতেই জিজ্ঞাসা করলো মিষ্টি মেয়েটা কে রে? জবাবে মৃণাল বললো আমার ভাইজি। নির্মলা হঠাৎ তার চেয়ার টা মৃণালের বিপরীতে ঘুরিয়ে নিয়ে বসলো। মৃণাল বললো এটা কি করছিস? চেয়ার টা ঘুরিয়ে নিলি কেন? প্রত্তুতরে নির্মলা বললো যতক্ষণ না আমার সব কথা বলা শেষ হচ্ছে ততক্ষণ তোর দিকে তাকাতে পারবো না। মনে হয় আমি সেই অধিকার হারিয়ে ফেলেছি। মৃণাল এই কথাটা শুনে কষ্ট পেলো, বুঝতে পারলো কতটা কষ্ট বুকে জমিয়ে বেঁচে আছে সে। তবু বললো এসব আর একবারও বলবি না, বন্ধুত্বে কোনো অধিকার কোনোদিন শেষ হয় না। তাই এতো দিন পরে হলেও তোর মন সায় দিয়েছে আর ছুটে এসেছিস বন্ধুত্বের টানে। তবু যদি তুই চাস কথা শেষ না করা পর্যন্ত আমার দিকে তাকাবি না, তাহলে ওইভাবেই থাক বারন করবো না। এসব কথা বলতে বলতেই ঘরের বাইরে থেকে আওয়াজ এলো, দাদা চা নিয়ে এসেছি। মৃণাল বললো, হ্যাঁ ভেতরে চলে এসো দরজা খোলা আছে। টেবিলের উপর রেখে দাও নিয়ে নিচ্ছি। ছোট নির্মলাও তার মায়ের পিছু পিছু ঘরে ঢুকে পড়েছে, তাকে কাছে টেনে নিয়ে নির্মলা বললো তোমার নাম কি? সে উত্তর দিলো আমার নাম নির্মলা। ও তাই, বা খুব মিষ্টি নাম তোমার। কোন ক্লাসে পড়ো? তৃতীয় শ্রেণীতে। বা খুব ভালো। চা টা টেবিলে রেখে হঠাৎ বলে উঠলো ওমা দিদি আপনি ওই দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসেছেন কেন? নির্মলা একটু ইতস্ততঃ বোধ করে বললো ও কিছু না, দেয়ালের ছবি গুলো দেখছিলাম, আমাদের কত পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। ও আচ্ছা, এই বলে ছোট নির্মলা কে নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। মৃণাল বললো নে এবার শুরু কর তোর কথা। নির্মলা বললো হ্যাঁ শুরু করছি, তবে প্রথমেই বলে রাখি, আমার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো কথা বলবি না, তোর যা জিজ্ঞাসা করার সব শেষে করবি। এই বলে শুরু করলো নির্মলা - রিমি তোকে সবই বলেছে সেই সূত্রে তুই জানিস যে আমি ওই বিষয় গুলো সবই জানতাম। এমনকি এটাও জানি যে কাঠগোলা থেকে বেড়িয়ে আসার পরদিন আমি যেদিন ভাগলপুর চলে যায় সেদিন তুই আমার মামার বাড়ি পর্যন্ত গেছিলি। হয়তো সবকিছু বলতে বা শুধু একবারের জন্য দেখা করতে। কিন্তু তুই জানতিস না সেদিন আমার ট্রেনের সময় টা ছিলো খুব সকালেই। তুই মামার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই দিদা আমাকে ফোন করে বলেছিল তোর কথা। আমি চলেগেছি শুনে তুই বাড়ির ভেতরেও যাসনি, বাড়ির সদর দরজার কাছ থেকেই ফিরে চলে গিয়েছিলি। তুই হয়তো অনেক ভেবেছিস যে আমি সব জানা সত্ত্বেও বা আমারো তোকে ভালোলাগা সত্ত্বেও বা আমরা পালিয়ে বিয়ে করে নিতে পারতাম তবু তোকে কোনো দিন কিছু বলিনি কেন? কারন রিমি বলেছিলো তুই একদিন ফোনে বলেছিলি তুই তোর বাবা মাকে ফেলে রেখে কোথাও পালাবি না। আর সেদিনের পর থেকে তোর প্রতি আমার ভালোবাসা আর সম্মান টা আরো বেড়ে গেছিলো। তবে আমি এটাও জানতাম যে যদি আমার বাড়ি থেকে সম্পর্কটা মেনে নেয় তাহলে তোর থেকে বেশী খুশি আর কেউ হবে না। তাই এখান থেকে বাড়ি যাবার পর দিনই আমি সাহস করে ব্যাপারটা বলি বাড়িতে। কিন্তু আমার বদমেজাজী বাবার মাথায় এতো রাগ উঠেছিলো কথাটা শুনে যে আমার গায়ে হাত তুলতেও এতটুকু বাধেনি। শুধু তাই নয় এও বলেছিল যে আমার বিয়ের নেমন্তন্নে তুই যদি ওখানে যাস তাহলে তোকে আর বেঁচে ফিরতে দেবে না। সেদিনই তোকে আমার ফোন থেকে শেষ কথাটা লিখেছিলাম যে, কোনো দিন আমার খোঁজ করিস না। তার পরই সিম কার্ড টা ভেঙে দিয়ে ফোনটা বাড়িতে দিয়ে দি, তার পর থেকে আজ পর্যন্ত ফোন ব্যবহার করিনি। আর নির্মলা জীবিত লাশ হয়ে বাঁচতে শিখে গেলো। রীতিমতো বাবার দেখা ছেলের সঙ্গেই বিয়ে হলো আমার। বিয়ের দুই মাসের মাথায় একটা পথদুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। সরকারি চাকরি করতো, ৫০ হাজার টাকা বেতন পেতো ঠিকই কিন্তু বাসর রাত থেকে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত এমন কোনো রাত যায়নি যেদিন আমাকে শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়নি, বাধা দেওয়া তো দূর তার চেষ্টা করতে গেলেই জুটতো খারাপ ভাষায় গালাগালি আর মার। শুধু সমাজের চোখেই আমাদের বিয়ে হয়েছিলো, কিন্তু আমি তার বউ ছিলাম না, ছিলাম শুধু তার শারীরিক চাহিদা মেটানোর যন্ত্র। বিয়ের কয়েক দিনের মধ্যেই যখন আমার বাড়িতে এসব জানতে পারলো তখন থেকে বাবা আমার সামনে আসে না। আমি বিধবা হবার কিছুদিন পরই বাবা অসুস্থ হয়ে পরে। একটাই মেয়ে তো তাই ধাক্কা টা সামলাতে পারেনি হয়তো। তার পর বাড়ির লোক আবার অন্য জায়গায় বিয়ের কথা তুলেছিলো। আমি বলেছিলাম যদি আমাকে তোমাদের সামনে জীবিত দেখতে চাও তাহলে দয়া করে আমাকে নিয়ে আর কিছু ভাবতে এসো না। তার পর থেকে আর কেউ কোনো দিন কিছু বলেনি। তার পর তো ৫ বছর গৃহবন্দী দশায় জীবন কাটিয়েছলাম। আমার এই অবস্থা দেখে মাও ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলো তাই ভাবলাম, না, আর এভাবে বাঁচা যাবে না। অনেকবার সুইসাইড করতেও ইচ্ছা হয়েছিল কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে করতে পারিনি। ৫ বছর পরে বাইরের পরিবেশ টা দেখলাম। ততদিনে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছিলো। এতো দিন বাবা অসুস্থ থাকার ফলে সংসারেও অনটন দেখা দিয়েছিলো। তার পর আমি সংসারের হাল ধরলাম। আমাদের বিশাল সম্পত্তির মধ্যে কয়েক বিঘা বিক্রি করে সেই টাকা ব্যাঙ্কে রাখলাম, সেখান থেকে যা সুদ আসে তাতেই সংসার চলে যায়। সেই টাকা থেকে একটা ল্যাপটপ ও কিনি যাতে বাড়িতে বসেই কোনো কাজ করতে পারি। ৫ বছর পরে আবার সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবার পর জানতে পারি তোদের কথা। তুই কত বড়ো ব্যাবসায়ী হয়েছিস, দেশজুড়ে তোর নামডাক। আর তোর লিখা গুলোও একটাও বাদ রাখিনা। সারাদিন কাজের পর রাতে খাবার পর রোজ তোর লিখাগুলো পড়ি। সব পত্রিকার সম্পাদক রা তোর লিখা ছাপাতে চায়, এতটাই ভালো লিখিস তুই। আমার কথাগুলো শুনে হয়তো ভাববি যে 5 বছর পরেই যদি আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিলাম তবে এতো দিন তোদের সঙ্গে যোগাযোগ করিনি কেনো? হয়তো আর কোনো দিন দেখা করতাম না কিন্তু আজ থেকে ১০ দিন আগে হঠাৎ বাবা আমাকে উনার ঘরে ডেকে পাঠায়, গিয়ে দেখি আগে থেকেই মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে। আমি বললাম বাবা আমি এমন কি অপরাধ করেছি যে তুমি জীবিত থেকেও ১২ বছর আমি তোমার মুখ দেখিনি? বাবা ঐভাবে শুয়ে থেকেই কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিলো , ধুর পাগলি তুই কেন অপরাধ করবি, করেছি তো আমি। অপরাধ নয়, পাপ করেছি। সেই পাপের শাস্তি ভোগ করছি আমি। ততক্ষণে দুজনেই কাঁদছিলাম। আমি বললাম ওসব ভেবে তুমি কষ্ট পেও না বাবা, আমার ভাগ্যে যা ছিলো তাই হয়েছে। তার পর বাবা বললো আমার একটা কথা রাখবি মা? বললাম হ্যাঁ রাখবো বলো। কিন্তু বাবা যে এরকম কিছু একটা চেয়ে বসবে জানতাম না। হঠাৎ বাবা বললো মৃণালের কাছে গিয়ে আমার হয়ে ক্ষমা চেয়ে আসতে পারবি? আর হয়তো বেশিদিন বাঁচবো না, তার আগে এই প্রায়শ্চিত্ত টুকু করে যেতে পারলে একটু শান্তি পাবো। সেই কথা রাখতেই আমার আসা। সব যে কি থেকে কি হয়ে গেল?
একদিকে নির্মলা এগুলো কাঁদতে কাঁদতে বলছে আর অন্য দিকে মৃণাল সব শুনতে শুনতে কাঁদছে। শুধু বাবার তরফ থেকেই নয় আমিও তোর কাছে ক্ষমা প্রার্থী, তাই আমাকেও পারলে ক্ষমা করে দিস। নির্মলার কথা শেষ হলো। প্রায় ২ মিনিট কারো মুখ দিয়ে কোনো কথা বেড়োলো না দুজনেই অনর্গল কেঁদে গেল। তারপর মৃনাল বললো এবার আমার দিকে মুখ করে বসতে পারিস। নির্মলা ঘুরে বসলো কিন্তু তখনো মুখ তুলে তাকাচ্ছিলো না মৃণালের দিকে। মৃণাল বললো আমার সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞেস করে নে তার পর এইসবের উত্তর দিচ্ছি। নির্মলা বললো তোর প্রত্যেকটা ইন্টারভিউ আমার দেখা আছে তাই মোটামুটি তোর ব্যাপারে অনেক কিছু জানি। আগে তুই ক্ষমা করেছিস কিনা সেটা বল তার পর যদি ইচ্ছা হয় তবেই কিছু জিজ্ঞাসা করবো। মৃণাল তার নিজের ফোনটা নির্মলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো তোর বাড়িতে ফোন টা লাগিয়ে দে আমি তোর বাবার সঙ্গে কথা বলবো। এবার মৃনালের চোখের দিকে তাকালো নির্মলা। মৃণাল বললো তাকিয়ে লাভ নেই যা বললাম তা কর। নির্মলা সেই মতোই কাজ করলো, প্রথমে তার মা ফোনটা ধরে, নির্মলা বললো বাবাকে ফোনটা দাও মৃণাল কথা বলবে। এর পর নির্মলার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে মৃণাল কানে ধরলো আর বিপরীত দিকে নির্মলার বাবা। বিপরীত দিকে কান্নার আওয়াজ পেয়ে বলতে শুরু করলো মৃণাল। দেখুন কেঁদে লাভ নেই। যা হয়ে গেছে সেটা আমরা কেউই পাল্টাতে পারবো না। আর আপনি আমার কাছে ক্ষমা চাইতে পাঠিয়েছেন? একমাত্র মেয়ের বাবা হয়ে নিজের চোখে মেয়েকে বিধবা দেখছেন এর থেকে বড়ো প্রায়শ্চিত্ত আর কি হতে পারে বলুন। দেখুন ১০ বছর হলো আমার বাবা-মা দুজনেই গত হয়েছেন, তাই আপনাকে বাবা বলেই ডাকছি। আমি যদি আপনার কাছে একটা ভিক্ষা চাই তাহলে দিবেন। এবার মুখ ফুটলো নির্মলার বাবার, এরকম কেন বলছো বাবা, আমার কাছে কিছুই নেই যা তোমাকে দিতে পারবো। মৃণাল বললো আমি যদি বলি আমার জীবনের সবথেকে মূল্যবান জিনিস টা আপনার কাছেই আছে। এবার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো নির্মলা। সে বুঝতে পারছে মৃণাল কি বলতে চাইছে। মৃণাল নির্দিধায় বলে ফেললো আপনি রাজী থাকলে আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। নির্মলা বলে উঠলো কি বলছিস এসব? মৃণাল এক হাতের ইশারায় চুপ করতে বললো নির্মলা কে। তার পর প্রায় মিনিট খানেক কানে ফোন ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো মৃণাল। বিপরীত দিক থেকে কি উত্তর আসছে বুঝে উঠতে পারছে না নির্মলা। তার পর কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিলো মৃণাল। তখনই বাইরে থেকে গাড়ির আওয়াজ এলো। মৃণাল জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলো রিমি আর সেবিনা এসেছে। মৃণাল সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা বিছানায় ফেলে দিয়ে নির্মলার কাছে এসে তার হাত দুটো ধরে বললো বিয়ের পরে ওগো, হ্যাঁগো বলে ডাকতে পারবো না কইরে নির্মলা এইভাবেই ডাকবো কিন্তু, এই পাগলাটার পাগলামি সহ্য করতে পারবি তো? একথা শোনা মাত্র নির্মলা মৃণালকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে তার পিঠ ভাসালো।
🙏নমস্কার🙏