Sunday, June 14, 2020

গল্প- নির্মলা অন্তিম পর্ব

                     গল্প- নির্মলা
                           বিমান চন্দ্র দাস
                      অন্তিম পর্ব

সকাল তখন ৭ টা মৃণাল ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে বেড়ানোর জন্য তৈরী হচ্ছে । সে এখন দিল্লিতে, আজ গ্রামের বাড়ি ফিরছে। কারন আগামী কাল হোলি, আর গত ১২ বছরে এমন কোনো বছর যায়নি যে বসন্ত উৎসবে সে গ্রামের বাড়িতে থাকেনি। হ্যাঁ ১২ বছর। দেখতে দেখতে ১২ বছর হয়ে গেল। এই ১২ বছরে প্রতি বছরে হোলির দিন মৃণাল বাড়িতেই সময় কাটায়। দুপুরে খাবার পর ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে বেড়িয়ে পরে কলেজের উদ্দেশ্যে। কলেজের সামনে গিয়ে আনমনে কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তার পর মাথার মধ্যে এসে ভির করে পুরোনো দিনের স্মৃতি। সেগুলো ভাবতে ভাবতেই নিজের অজান্তেই কখন চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। চোখের সামনে হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রী দের রঙের উৎসবে মেতে উঠতে দেখে মনে পড়ে যায় তাদের কলেজ জীবনের কথা। তবে বেশিক্ষন সেখানে সে দাঁড়ায় না, মানুষ তাকে চিনে ফেললে সেখানে ভির জমে যেতে পারে । তার কারন সে এখন স্বনামধন্য ব্যাক্তি। একাধারে সে স্বনামধন্য ব্যাবসায়ী আবার তার পাশাপাশি স্বনামধন্য লেখকও বটে। কলেজের সামনে থেকে একটু হেঁটে গিয়ে নদীর পাড়ে বসে সে। তার পর শুরু হয় ফোন। রিমি, সেবিনা, কাকলি, সুমন্ত সবাই জানে বসন্ত উৎসবে বিষেশত হোলির দিন মৃণালের ফোন আসবেই। শুধু মাত্র কথা হতো না নির্মলার সঙ্গে। ১২ বছর আগে কাঠগোলা বাগান বাড়িতে সেই শেষ কথা আর শেষ দেখা হয়েছিল তাদের। তার পর কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই নির্মলার। এমনকি ফোন নম্বরটাও পরিবর্তন করে নিয়েছে। ভাগলপুর যাবার ২ দিন পর নির্মলা মৃনাল কে একটা  হোয়াট্সঅ্যাপ বার্তায় বলেছিল ভুল করেও আমার খোঁজে কোনোদিন ভাগলপুর আসিস না, তার পর থেকে আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। নদীর পাড়ে বসে ফোন করার পর সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি ফিরে যায় মৃনাল, আর তার পর শুরু হয় ডায়েরি লিখা। এবারো তার অন্যথা হবে না। দিল্লি থেকে বাড়ি ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। তার গ্রামের বাড়িতে তার ভাই, ভাইয়ের বউ আর ৮ বছরের এক মেয়ে থাকে। মৃনাল অনেকবার বলেছে তার কলকাতার ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকতে, কিন্তু তার ভাইয়ের বক্তব্য সে গ্রামের বাড়িতেই থাকতে চায়। বর্তমানে ভারতবর্ষের 6 টা বড়ো বড়ো ব্যাবসার মালিক মৃণাল। মৃণাল অনেকটা পথ অতিক্রম করে এসেছে তাই দরজাটা এঁটে দিয়ে ঘুমোতে যাবে এমন সময় দরজার বাইরে থেকে তার ভাইয়ের ডাক শুনতে পেল। দরজা খুলতেই দেখে একটা চিঠির খাম হাতে দাঁড়িয়ে তার ভাই। খামটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো এই নে তোর নামে আজ সকালে এই চিঠি টা এসেছে । তুই আসছিস জেনে ফোন করে আর বলিনি। চিঠি টা হাতে নিয়ে বললো আচ্ছা ঠিক আছে। দরজা লাগানোর আগেই তার ভাইকে বললো নির্মলা টিউশন থেকে এলে এই চকলেট গুলো দিয়ে দিস। রাত্রে খাবার কিছুক্ষন আগে তুলে দিস তখন বসে ওর সঙ্গে গল্প করবো। এই বলে দরজাটা এঁটে দিলো। চিঠির খামটা টেবিলে রেখে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লো। রাত 8 টা নাগাদ মৃনালের ঘুম ভাঙ্গলো। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে নির্মলা ছুটে এলো মৃণালের ঘরে। এই নির্মলা হলো মৃণালের ভাইয়ের মেয়ে, নামটা মৃণালের ই দেওয়া। মৃণাল হাত মুখ ধুয়ে ঘন্টা খানেক তার ভাইজির সঙ্গে গল্পের ছলে খেলা করলো। তার পর নির্মলার মা এসে বললো দাদা রান্না হয়ে গেছে, কখন খাবেন বলবেন। মৃণাল বললো ও আচ্ছা, ভাই কোথায়? উত্তর এলো আপনি রসমালাই খুব পছন্দ করেন তাই বাজার গেছে শ্যাম ময়রার দোকান। এক্ষুনি চলে আসবে। মৃণাল বললো ঠিক আছে ভাই এলে একসঙ্গে খেয়ে নিবো।
পরদিন সকালে উঠে একটু গ্রামটা ঘুরতে বেড়োলো মৃণাল। দুপুরে খাবার পর হঠাৎ মনে পড়লো কালকের চিঠির কথা, দেখলো টেবিলের উপর যথা স্থানেই রাখা আছে সেটি। হাতে তুলে নিয়ে এপিঠ ওপিঠ উল্টে দেখলো কারো নাম লিখা নেই। তবে তার নিজের ঠিকানাটার দিকে ভালো করে দেখা মাত্র অবাক সে! এতো নির্মলার হাতের লিখা! এর পর আর কিছু না দেখেই সঙ্গে সঙ্গে চিঠি টা খুলে পড়তে শুরু করলো সে।
      "জানিনা এখন আমাকে ঘৃনা করিস, নাকি আমার উপর রাগ করে আছিস,  নাকি এখনো আগের মতোই ভালোবাসিস? তবে এটা ভালো করে জানি যে, প্রেমিকা নির্মলার উপর রেগে থাকলেও বন্ধু নির্মলার উপর রেগে থাকতে পারবি না।
আমি জানি তুই হোলি তে গ্রামের বাড়িতে থাকিস তাই হোলির পর দিনই আসছি আমি। পারলে রিমি কে কথাটা জানিয়ে দিস, সম্ভব হলে বাকিদের ও বলে দিস। ৪ দিন থাকবো মুর্শিদাবাদে। তাদের কে বলিস পারলে যেন দেখা করে।
       ইতি -
          তোদের হতভাগী নির্মলা। "
চিঠিটা পড়ার সময় মৃণালের চোখের জল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উথাল-পাথাল করতে লাগলো চোখেই। চিঠি টা পড়ার পর অনেক প্রশ্ন এসে ভির করলো মৃণালের মনে। সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটের যুগে নির্মলা চিঠি কেনো লিখলো? চিঠির শেষে সে নিজেকে হতভাগী কেন বলেছে? আর সব থেকে বড়ো প্রশ্ন হলো যোগাযোগ করলই যদি তাহলে ১২ বছর পরে কেন? এত দিন কোথায় ছিল সে? সে কেমন আছে সেটা পর্যন্ত লেখেনি চিঠিতে, তাহলে কি সে ভালো নেই? এই প্রশ্ন গুলো মনকে চঞ্চল করে তুললো মৃণালের। বিছানায় শুয়ে সেগুলোই ভাবতে থাকলো সে,  কিন্তু কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না। সেদিনও প্রতি বছরের ন্যায় কলেজের সামনে গেল মৃণাল। নদীর পাড়ে বসে রিমি কে ফোন করলো, একে একে সবাই কে যুক্ত করলো রিমি। রিমি এখন বীরভূম জেলার রামপুরহাটে থাকে। স্বামী আর দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার তাদের। সেবিনা ও কাকলির অবস্থাও তাই। তবে সেবিনা থাকে বহরমপুরেই আর কাকলির বিয়ে হয়েছে নদীয়ার কৃষ্ণনগরে। আর সুমন্ত তার এক দুর সম্পর্কের আত্মীয়ের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করেছে বহরমপুরেই। আর মৃণালের জন্য শুধু মুর্শিদাবাদ নয় বা শুধু এরাজ্য নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখনো বিয়ের প্রস্তাব আসে, কিন্তু তার এক বাক্য, সে বিয়ে করবে না। ফোনে মৃনাল চিঠির কথাটা বলতেই সবাই অবাক। প্রথমে রেগে কাকলি বললো এতোদিনে মনে পড়েছে মহারানীর। কিন্তু পরোক্ষনেই কান্না নেমে এলো সবার চোখে। সবাই একসুরে বলে উঠলো কাল সূর্য পূর্ব দিকে উঠুক বা পশ্চিমে, ভূমিকম্প আসুক বা মহাপ্রলয় হোক, যেভাবেই হোক না কেন, কাল আমরা সবাই আসছি তোর বাড়ি। মৃণাল বললো ঠিক আছে। সেদিন মৃণাল অনেক কেনাকাটা করে একটু রাত করে বাড়ি ফিরলো। তার হাতে এতো বাজারের থলি দেখে তার ভাই জিজ্ঞাসা করলো, কি ব্যাপার দাদা এতো মালপত্র কিসের? মৃণাল বললো কাল আমার কয়েকজন  কলেজের বন্ধু আসবে, কই নির্মলার মাকে একটু ডাকতো। একথা বলতে বলতেই নির্মলার মা সেখানে হাজির। মৃনাল তার দিকে বাজারের থলি গুলো এগিয়ে দিয়ে বললো, এই নাও কাল তোমার একটু কষ্ট বাড়িয়ে দিলাম। সেদিন রাতে মৃণালের অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম এলো না। তার মনের অবস্থা কাউকে বলতে পারছে না সে, শুধু মনের কথা গুলো কলমের রেখা দিয়ে ডায়েরির পাতাকে বলে রাখছে। পরদিন সকালে উঠেই মৃনালের ব্যস্ততা তুঙ্গে। আজ ১২ বছর পরে নির্মলার সঙ্গে দেখা হবে এই ভেবেই তার মনে জলকম্পের ন্যায় ঢেউয়ের টালমাটাল খেলা চলছে। সকাল তখন ৯ টা হবে, মৃণালের ভাইজি বাড়ির উঠোন থেকে দৌড়ে ভেতরে গিয়েই তার মাকে বলছে, মা জ্যাঠামশায়ের ঘরে যেই আন্টি গুলোর ছবি আছে সেরকমই দেখতে একটা আন্টি এসেছে। কথাটা শুনে মৃণালের বুকে যেন পাহাড় ভেঙ্গে পড়লো। এক ছুটে বাইরে এসে দেখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নির্মলা। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের চোখে চোখ রেখে তাকানো, তার পর কেউ কারো দিকে তাকিয়ে উঠতে পারলো না। সেই কয়েক সেকেন্ডের তাকানোতেই মৃণাল দেখলো নির্মলা সেই আগের নির্মলা নেই। অপ্সরার মতো দেখতে তার চেহারা আজ মলিন হয়ে এসেছে। যে মুখে সর্বদা বসন্ত ঝরা হাসি লেগে থাকতো সেই মুখে আজ হাসির চিহ্ন মাত্র নেই। সেই হাসিট যেনো কোনো এক অজানা ভুলে ঢাকা পড়ে গেছে। তার চেহারার ঔজ্জ্বলতা যেন হাজারো চিন্তার ভিরে কোথায় হারিয়ে গেছে। কোনো এক ব্যর্থতা যেন তার পিছু ধাওয়া করে বেড়াচ্ছ তাকে। সব মিলিয়ে সে আজ জরাগ্রস্ত। তবে সব থেকে যে বিষয় টা মৃণালকে অবাক করলো তা হলো নির্মলার সিঁথিতে সিঁন্দুর দেখতে পেলো না।  তাহলে কি সেও মৃণালের মতোই ... নাকি ...? যাই হোক পরে সেটা জিজ্ঞেস করে নেওয়া যাবে। মৃণাল তার দিকে তাকানোর ভান করে বললো আয় ঘরে আয়। ঘরের দিকে এগিয়ে যেতেই মৃনালের ভাইজি অর্থাৎ ছোট নির্মলার দিকে চোখ পড়লো তার। ঘরে বসতেই জিজ্ঞাসা করলো মিষ্টি মেয়েটা কে  রে? জবাবে মৃণাল বললো আমার ভাইজি। নির্মলা হঠাৎ তার চেয়ার টা মৃণালের বিপরীতে ঘুরিয়ে নিয়ে বসলো। মৃণাল বললো এটা কি করছিস? চেয়ার টা ঘুরিয়ে নিলি কেন? প্রত্তুতরে নির্মলা বললো যতক্ষণ না আমার সব কথা বলা শেষ হচ্ছে ততক্ষণ তোর দিকে তাকাতে পারবো না। মনে হয় আমি সেই অধিকার হারিয়ে ফেলেছি। মৃণাল এই কথাটা শুনে কষ্ট পেলো, বুঝতে পারলো কতটা কষ্ট বুকে জমিয়ে বেঁচে আছে সে। তবু বললো এসব আর একবারও বলবি না, বন্ধুত্বে কোনো অধিকার কোনোদিন শেষ হয় না। তাই এতো দিন পরে হলেও তোর মন সায় দিয়েছে আর ছুটে এসেছিস বন্ধুত্বের টানে। তবু যদি তুই চাস কথা শেষ না করা পর্যন্ত আমার দিকে তাকাবি না, তাহলে ওইভাবেই থাক বারন করবো না। এসব কথা বলতে বলতেই ঘরের বাইরে থেকে আওয়াজ এলো, দাদা চা নিয়ে এসেছি। মৃণাল বললো, হ্যাঁ ভেতরে চলে এসো দরজা খোলা আছে। টেবিলের উপর রেখে দাও নিয়ে নিচ্ছি। ছোট নির্মলাও তার মায়ের পিছু পিছু ঘরে ঢুকে পড়েছে, তাকে কাছে টেনে নিয়ে নির্মলা বললো তোমার নাম কি? সে উত্তর দিলো আমার নাম নির্মলা। ও তাই, বা খুব মিষ্টি নাম তোমার। কোন ক্লাসে পড়ো? তৃতীয় শ্রেণীতে। বা খুব ভালো। চা টা টেবিলে রেখে হঠাৎ বলে উঠলো ওমা দিদি আপনি ওই দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসেছেন কেন? নির্মলা একটু ইতস্ততঃ বোধ করে বললো ও কিছু না, দেয়ালের ছবি গুলো দেখছিলাম, আমাদের কত পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। ও আচ্ছা, এই বলে ছোট নির্মলা কে নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। মৃণাল বললো নে এবার শুরু কর তোর কথা। নির্মলা বললো হ্যাঁ শুরু করছি, তবে প্রথমেই বলে রাখি, আমার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো কথা বলবি না, তোর যা জিজ্ঞাসা করার সব শেষে করবি। এই বলে শুরু করলো নির্মলা - রিমি তোকে সবই বলেছে সেই সূত্রে তুই জানিস যে আমি ওই বিষয় গুলো সবই জানতাম। এমনকি এটাও জানি যে কাঠগোলা থেকে বেড়িয়ে আসার পরদিন আমি যেদিন ভাগলপুর চলে যায় সেদিন তুই আমার মামার বাড়ি পর্যন্ত গেছিলি। হয়তো সবকিছু বলতে বা শুধু একবারের জন্য দেখা করতে। কিন্তু তুই জানতিস না সেদিন আমার ট্রেনের সময় টা ছিলো খুব সকালেই। তুই মামার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই দিদা আমাকে ফোন করে বলেছিল তোর কথা। আমি চলেগেছি শুনে তুই বাড়ির ভেতরেও যাসনি, বাড়ির সদর দরজার কাছ থেকেই ফিরে চলে গিয়েছিলি। তুই হয়তো অনেক ভেবেছিস যে আমি সব জানা সত্ত্বেও বা আমারো তোকে ভালোলাগা সত্ত্বেও বা আমরা পালিয়ে বিয়ে করে নিতে পারতাম তবু তোকে কোনো দিন কিছু বলিনি কেন? কারন রিমি বলেছিলো তুই একদিন ফোনে বলেছিলি তুই তোর বাবা মাকে ফেলে রেখে কোথাও পালাবি না। আর সেদিনের পর থেকে তোর প্রতি আমার ভালোবাসা আর সম্মান টা আরো বেড়ে গেছিলো। তবে আমি এটাও জানতাম যে যদি আমার বাড়ি থেকে সম্পর্কটা মেনে নেয় তাহলে তোর থেকে বেশী খুশি আর কেউ হবে না। তাই এখান থেকে বাড়ি যাবার পর দিনই আমি সাহস করে ব্যাপারটা বলি বাড়িতে। কিন্তু আমার বদমেজাজী বাবার মাথায় এতো রাগ উঠেছিলো কথাটা শুনে যে আমার গায়ে হাত তুলতেও এতটুকু বাধেনি। শুধু তাই নয় এও বলেছিল যে আমার বিয়ের নেমন্তন্নে তুই যদি ওখানে যাস তাহলে তোকে আর বেঁচে ফিরতে দেবে না। সেদিনই তোকে আমার ফোন থেকে শেষ কথাটা লিখেছিলাম যে, কোনো দিন আমার খোঁজ করিস না। তার পরই সিম কার্ড টা ভেঙে দিয়ে ফোনটা বাড়িতে দিয়ে দি, তার পর থেকে আজ পর্যন্ত ফোন ব্যবহার করিনি। আর নির্মলা জীবিত লাশ হয়ে বাঁচতে শিখে গেলো। রীতিমতো বাবার দেখা ছেলের সঙ্গেই বিয়ে হলো আমার। বিয়ের দুই মাসের মাথায় একটা পথদুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। সরকারি চাকরি করতো, ৫০ হাজার টাকা বেতন পেতো ঠিকই কিন্তু বাসর রাত থেকে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত এমন কোনো রাত যায়নি যেদিন আমাকে শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়নি, বাধা দেওয়া তো দূর তার চেষ্টা করতে গেলেই জুটতো খারাপ ভাষায় গালাগালি আর মার। শুধু সমাজের চোখেই আমাদের বিয়ে হয়েছিলো, কিন্তু আমি তার বউ ছিলাম না, ছিলাম শুধু তার শারীরিক চাহিদা মেটানোর যন্ত্র। বিয়ের কয়েক দিনের মধ্যেই যখন আমার বাড়িতে এসব জানতে পারলো তখন থেকে বাবা আমার সামনে আসে না। আমি বিধবা হবার কিছুদিন পরই বাবা অসুস্থ হয়ে পরে। একটাই মেয়ে তো তাই ধাক্কা টা সামলাতে পারেনি হয়তো। তার পর বাড়ির লোক আবার অন্য জায়গায় বিয়ের কথা তুলেছিলো।  আমি বলেছিলাম যদি আমাকে তোমাদের সামনে জীবিত দেখতে চাও তাহলে দয়া করে আমাকে নিয়ে আর কিছু ভাবতে এসো না। তার পর থেকে আর কেউ কোনো দিন কিছু বলেনি। তার পর তো ৫ বছর গৃহবন্দী দশায় জীবন কাটিয়েছলাম। আমার এই অবস্থা দেখে মাও ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলো তাই ভাবলাম, না, আর এভাবে বাঁচা যাবে না। অনেকবার সুইসাইড করতেও ইচ্ছা হয়েছিল কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে করতে পারিনি। ৫ বছর পরে বাইরের পরিবেশ টা দেখলাম। ততদিনে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছিলো। এতো দিন বাবা অসুস্থ থাকার ফলে সংসারেও অনটন দেখা দিয়েছিলো। তার পর আমি সংসারের হাল ধরলাম। আমাদের বিশাল সম্পত্তির মধ্যে কয়েক বিঘা বিক্রি করে সেই টাকা ব্যাঙ্কে রাখলাম, সেখান থেকে যা সুদ আসে তাতেই সংসার চলে যায়। সেই টাকা থেকে একটা ল্যাপটপ ও কিনি যাতে বাড়িতে বসেই কোনো কাজ করতে পারি। ৫ বছর পরে আবার সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবার পর জানতে পারি তোদের কথা। তুই কত বড়ো ব্যাবসায়ী হয়েছিস, দেশজুড়ে তোর নামডাক। আর তোর লিখা গুলোও একটাও বাদ রাখিনা। সারাদিন কাজের পর রাতে খাবার পর রোজ তোর লিখাগুলো পড়ি। সব পত্রিকার সম্পাদক রা তোর লিখা ছাপাতে চায়, এতটাই ভালো লিখিস তুই। আমার কথাগুলো শুনে হয়তো ভাববি যে 5 বছর পরেই যদি আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিলাম তবে এতো দিন তোদের সঙ্গে যোগাযোগ করিনি কেনো? হয়তো আর কোনো দিন দেখা করতাম না কিন্তু আজ থেকে ১০ দিন আগে হঠাৎ বাবা আমাকে উনার ঘরে ডেকে পাঠায়, গিয়ে দেখি আগে থেকেই মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে। আমি বললাম বাবা আমি এমন কি অপরাধ করেছি যে তুমি জীবিত থেকেও ১২ বছর আমি তোমার মুখ দেখিনি? বাবা ঐভাবে শুয়ে থেকেই কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিলো , ধুর পাগলি তুই কেন অপরাধ করবি, করেছি তো আমি। অপরাধ নয়,  পাপ করেছি। সেই পাপের শাস্তি ভোগ করছি আমি। ততক্ষণে দুজনেই কাঁদছিলাম। আমি বললাম ওসব ভেবে তুমি কষ্ট পেও না বাবা, আমার ভাগ্যে যা ছিলো তাই হয়েছে। তার পর বাবা বললো আমার একটা কথা রাখবি মা? বললাম হ্যাঁ রাখবো বলো। কিন্তু বাবা যে এরকম কিছু একটা চেয়ে বসবে জানতাম না। হঠাৎ বাবা বললো মৃণালের কাছে গিয়ে আমার হয়ে ক্ষমা চেয়ে আসতে পারবি? আর হয়তো বেশিদিন বাঁচবো না, তার আগে এই প্রায়শ্চিত্ত টুকু করে যেতে পারলে একটু শান্তি পাবো। সেই কথা রাখতেই আমার আসা। সব যে কি থেকে কি হয়ে গেল?
একদিকে নির্মলা এগুলো কাঁদতে কাঁদতে বলছে আর অন্য দিকে মৃণাল সব শুনতে শুনতে কাঁদছে। শুধু বাবার তরফ থেকেই নয় আমিও তোর কাছে ক্ষমা প্রার্থী, তাই আমাকেও পারলে ক্ষমা করে দিস। নির্মলার কথা শেষ হলো। প্রায় ২ মিনিট কারো মুখ দিয়ে কোনো কথা বেড়োলো না দুজনেই অনর্গল কেঁদে গেল। তারপর মৃনাল বললো এবার আমার দিকে মুখ করে বসতে পারিস। নির্মলা ঘুরে বসলো কিন্তু তখনো মুখ তুলে তাকাচ্ছিলো না মৃণালের দিকে। মৃণাল বললো আমার সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞেস করে নে তার পর এইসবের উত্তর দিচ্ছি। নির্মলা বললো তোর প্রত্যেকটা ইন্টারভিউ আমার দেখা আছে তাই মোটামুটি তোর ব্যাপারে অনেক কিছু জানি। আগে তুই ক্ষমা করেছিস কিনা সেটা বল তার পর যদি ইচ্ছা হয় তবেই কিছু জিজ্ঞাসা করবো। মৃণাল তার নিজের ফোনটা নির্মলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো তোর বাড়িতে ফোন টা লাগিয়ে দে আমি তোর বাবার সঙ্গে কথা বলবো। এবার মৃনালের চোখের দিকে তাকালো নির্মলা। মৃণাল বললো তাকিয়ে লাভ নেই যা বললাম তা কর। নির্মলা  সেই মতোই কাজ করলো, প্রথমে তার মা ফোনটা ধরে, নির্মলা বললো বাবাকে ফোনটা দাও মৃণাল কথা বলবে। এর পর নির্মলার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে মৃণাল কানে ধরলো আর বিপরীত দিকে নির্মলার বাবা। বিপরীত দিকে কান্নার আওয়াজ পেয়ে বলতে শুরু করলো মৃণাল। দেখুন কেঁদে লাভ নেই। যা হয়ে গেছে সেটা আমরা কেউই পাল্টাতে পারবো না। আর আপনি আমার কাছে ক্ষমা চাইতে পাঠিয়েছেন? একমাত্র মেয়ের বাবা হয়ে নিজের চোখে মেয়েকে বিধবা দেখছেন এর থেকে বড়ো প্রায়শ্চিত্ত আর কি হতে পারে বলুন। দেখুন ১০ বছর হলো আমার বাবা-মা দুজনেই গত হয়েছেন, তাই আপনাকে বাবা বলেই ডাকছি। আমি যদি আপনার কাছে একটা ভিক্ষা চাই তাহলে দিবেন। এবার মুখ ফুটলো নির্মলার বাবার, এরকম কেন বলছো বাবা, আমার কাছে কিছুই নেই যা তোমাকে দিতে পারবো। মৃণাল বললো আমি যদি বলি আমার জীবনের সবথেকে মূল্যবান জিনিস টা আপনার কাছেই আছে। এবার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো নির্মলা। সে বুঝতে পারছে মৃণাল কি বলতে চাইছে। মৃণাল নির্দিধায় বলে ফেললো আপনি রাজী থাকলে আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। নির্মলা বলে উঠলো কি বলছিস এসব? মৃণাল এক হাতের ইশারায় চুপ করতে বললো নির্মলা কে। তার পর প্রায় মিনিট খানেক কানে ফোন ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো মৃণাল। বিপরীত দিক থেকে কি উত্তর আসছে বুঝে উঠতে পারছে না নির্মলা। তার পর কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিলো মৃণাল। তখনই বাইরে থেকে গাড়ির আওয়াজ এলো। মৃণাল জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলো রিমি আর সেবিনা এসেছে। মৃণাল সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা বিছানায় ফেলে দিয়ে নির্মলার কাছে এসে তার হাত দুটো ধরে  বললো বিয়ের পরে  ওগো, হ্যাঁগো বলে ডাকতে পারবো না কইরে নির্মলা এইভাবেই ডাকবো কিন্তু, এই পাগলাটার পাগলামি সহ্য করতে পারবি তো?  একথা শোনা মাত্র নির্মলা মৃণালকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে তার পিঠ ভাসালো।

No comments:

Post a Comment