গল্প- নির্মলা
বিমান চন্দ্র দাস
অষ্টম পর্ব
শুভ জন্মদিনের বার্তার সঙ্গে ঘুম ভাঙ্গলো নির্মলার। সেদিন সবাই সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়েছিলো লালবাগের উদ্দেশ্যে। প্রায় ১০ টা নাগাদ হাজির হলো কাঠগোলা বাগান বাড়ির সামনে, ততক্ষণে কাকলি আর সুমন্ত সেখানে এসে অপেক্ষা করছিল। সবাই এক জায়গায় হতেই একটা খুশির আমেজ।
রাস্তার পাশেই একটি সিংহদ্বার তার সামনে অনেক মানুষের সমাগম।
সেই দ্বারের ভেতরে প্রবেশ করতেই দুই ধারে অগনিত গাছ আর তার মধ্যেই কিছু ঐতিহাসিক স্তম্ভ আর কিছু অশ্বারোহী মূর্তি। মধ্যের সরু রাস্তা ধরে কয়েক পা এগোতেই দেখা গেল টিকিট কাউন্টার। সেখানে টিকিট কেটে এবার আসল জায়গায় প্রবেশ করলো তারা। কাকলি বললো একটা গাইড নিলে ভালো হতো। মৃণাল তার উত্তরে বললো গাইডের দরকার হবে না, চল আমি সব বুঝিয়ে বলছি। সুমন্ত মজার ছলে বলে উঠলো হ্যাঁ চল আজ আমাদের বাংলার শিক্ষক মহাশয় ইতিহাস পড়াবেন। হাসি-ঠাট্টা করতে করতেই এগোচ্ছে তারা। মুখ্য বাড়িটি পৌঁছাবার আগেই বাম দিকে গুপ্ত সুড়ঙ্গ আর ডান দিকে চিড়িয়াখানা। মৃণাল বললো এগুলো পড়ে দেখবো আগে প্রধান যে বাড়িটা সেটা দেখে নি। সেই কথামতো এগিয়ে গেল তারা। এবার কাঠগোলা বাগান বাড়ির সামনে উপস্থিত হলো। কি সুন্দর দৃশ্য,
বাড়িটির সামনেই একটা বিশাল পুকুর। পুকুরটির চারকোনে ও বাড়ির সামনে এবং তার বিবরীত পাড়ে সুন্দর ভাবে মোট ছয়টি ঘাট বাঁধানো। বাড়ির সামনের ঘাটটিতে একটি সুন্দর ফোয়ারা। সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতেই পুকুরে দেখাগেলো রঙ - বেরঙের মাছ জলে খেলা করছে। হঠাৎ করেই মৃণালের গলার আওয়াজ, এই মাছ গুলো খাওয়া হয় না। আর এগুলোর মধ্যে যদি কোনো মাছ মারা যায় তাহলে তাকে কবর দেওয়া হয়। নবাবী আমল থেকেই চলে আসছে এই রীতি। কবরের স্থানটি পরে দেখতে পাবি তার আগে চল বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করি। ভেতরে প্রবেশ করতেই সেবিনা বললো জিনিস গুলো কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। মৃণাল জবাব দিলো, না চেনার কিছু নেই এখানে অনেক সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে। সেবিনা একটু উঁচু কন্ঠে আগ্রহের সঙ্গে বলে উঠলো হ্যাঁ মনে পড়েছে 'বলো দুগ্গা মাই কি' নামক সিনেমায় দেখেছি, এতক্ষণে সব মনে পড়ছে। মৃণাল তার কথা আবার শুরু করলো, এই ঐতিহাসিক বাড়িটির গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো হলো - কষ্টিপাথরের সিংহাসন, ১৮ ফুট উঁচু বেলজিয়াম আয়না, ৭৫ ফুট উঁচু বিনা স্তম্ভের কাঠের সিঁড়ি, মার্বেল টেবিল... ও হ্যাঁ এখানে যে মার্বেল টেবিল আছে তার সঙ্গে তাজমহলের মার্বেলের মিল পাওয়া যায়। চলতে চলতে সবাই একসঙ্গে থমকে গিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো মৃনালের দিকে। কাকলি বললো সত্যি তোকে যত দেখি ততই অবাক হয়ে যায়। নির্মলা ইয়ার্কির ছলে বললো তুই তো গাইড দের ব্যাবসা গুটিয়ে দিবি দেখছি। মৃণাল মুচকি হেসে বললো বেশি বকিস না সামনে এগিয়ে চল।
মুখ্য বাড়িটি থেকে বেড়িয়ে পূর্ব দিকে এগিয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে আঙ্গুলের ইশারায় দেখালো মৃণাল, ঐ যে ওখানে সামান্য উঁচু স্টেজের মতো আছে দেখছিস, ওটাকে জলসাঘর বা নাচমহল বলে। চল দেখে আসি। নাচমহলটির উপরে উঠে মৃনাল তার বক্তব্য চালু রাখলো, এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা নাচের আসর বসতো। ততকালীন নবাবী লোকেরা, ইংরেজ সাহেবরা ও ধনী ব্যাবসায়ী রা এখানে আসতো মনোরঞ্জনের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু নর্তকী কে নিয়ে আসা হতো এখানে। তখনকার ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় তাদের মধ্যে একজন ছিলো হীরা বাঈ। সে নাকি প্রতি সন্ধ্যায় নাচ করার জন্য ৫০০০ মুদ্রা নিতো। তার একটি বিশাল ছবি হাজারদুয়ারী তে টাঙ্গানো আছে। সেখান থেকে তারা দুই ধারে গোলাপের বাগান ছাড়িয়ে এগিয়ে চললো সামনের দিকে। একটু এগোতেই একটা ছোট স্তম্ভ লাগোয়া দুই ধারে দুটো মাছের মূর্তি দেখা গেল।
মৃনাল বললো এখানেই মাছেদের কবর দেওয়া হয়। মৃণাল বললো চল এবার ঐ মন্দিরটার মধ্যে প্রবেশ করি। তারা সবাই মন্দিরের বাইরে নির্দিষ্ট স্থানে জুতো খুলে হাত-পা ধুয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। এই মন্দিরের ভেতরে মোবাইল ব্যাবহারে নিষেধাজ্ঞা আছে। তাই তারা প্রবেশ করার আগেই সুইচ অফ করে দিলো। এমনকি এই মন্দিরে প্রবেশ করার পূর্বে সবাই কে কথা বলতেও বারন করা হয়। তবে ধর্ম - বর্ণ নির্বিশেষে সকল পর্যটকদেরই এখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়।
সেখান থেকে বেড়িয়ে নির্মলা বললো নবাব দের বাগানবাড়ি তে মন্দির কিভাবে এলো বুঝতে পারলাম না। এটা শোনার পর মৃণাল একটানা ১০ মিনিট বক্তৃতার ন্যায় বলতে থাকলো।
মৃণাল :- আমি এই জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, দেখতে চাইছিলাম প্রথম প্রথম আমার মনে যে প্রশ্ন আসতো সেটা তোরাও ভাবিস কিনা। এই বলে পুরো ইতিহাস বলতে শুরু করলো মৃণাল, এটি নবাবদের তৈরী নয়। রাজস্থান থেকে আগত এক ব্যাবসায়ী এটি নির্মাণ করান। তিনি ছিলেন জৈন ধর্মাবলম্বী, তাই এই মন্দিরটিও জৈন মন্দির। মন্দিরটি আদিনাথ মন্দির বা পরেশনাথ মন্দির নামে পরিচিত। আদিনাথ হলো জৈন ধর্মের প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভনাথের আরেক নাম। মন্দির টি প্রথম থেকে এখানে ছিলো না ১৮৭৩ সালে তৎকালীন বাড়িটির মালিক তার মায়ের ইচ্ছা তে এটি বানান। আর এই বাগানবাড়ি টি তৈরী করান বর্তমান জিয়াগঞ্জ শ্রীপত সিং কলেজের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীপত সিং দুগরের পূর্বপুরুষ লক্ষীপত দুগর। তারা চার ভাই ছিলেন - লক্ষীপত সিং দুগর, ধনপত সিং দুগর, মহীপত সিং দুগর ও জগপত সিং দুগর। তারা এখানে ব্যাবসার সূত্রে এসেছিলেন, এখানে এসে তখনকার সব থেকে ধনী ব্যাবসায়ী জগৎ শেঠের সঙ্গে তাদের ভালো সম্পর্ক হয়। সেই সুবাদেই তৎকালীন নবাবের কাছে মাত্র ১২০০ টাকায় ২৫০ বিঘা জমি কিনে নেন। তার পরই তৈরী করান এই বাগান বাড়ি টি। সিংহদ্বার দিয়ে প্রবেশের পরে পরেই যে চারজনের অশ্বারোহী মূর্তি দেখেছিলি সেগুলো এদের ই চার ভাইয়ের। বর্তমানে লক্ষীপত সিং দুগরের দশম প্রজন্ম সঞ্জয় সিং দুগর ও সিদ্ধার্থ সিং দুগর এই প্রাসাদটির দেখাশোনা করেন। তারা বর্তমানে কলকাতায় থাকেন। আসার সময় মুখ্য বাড়িটির পিছনে যে ভগ্নাবশেষ টি দেখলি সেটা অতীতে অতিথিশালা ছিলো। এর পর তারা বাড়িটির সামনে যে পুকুর টা আছে তার বিপরীত পাড়ে এলো, সেখান থেকে বাড়িটির অসাধারণ দৃশ্য চোখে পড়লো। আহা! কি দৃশ্য মন জুড়িয়ে গেলো সবার। মৃনাল বললো চল ঐ গাছের তলায় বসে টিফিন টা বের করে খেয়ে নি তার পর সুড়ঙ্গ আর চিড়িয়াখানা টা দেখবো। খাওয়ার পর পাঁচ মিনিট পুকুর পাড়েই বসলো তারা। কেউ ছবি তুলতে ব্যস্ত, কেউ পাইচারী করতে শুরু করলো। সেই সময় রিমি নির্মলাকে ডেকে বললো, নির্মলা আমি আর মিথ্যা বলতে পারছি না, আর কতদিন লুকিয়ে রাখবো? কিছু মনে করিস না আমি তোর প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গলাম আজই ওকে সব বলে দিবো। নির্মলা রিমির মুখে হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, এরকম করিস না বন্ধু। যা বলার এখান থেকে ফেরার পর বলিস। কালই আমি ভাগলপুর চলে যাবো আবার কবে তোদের সঙ্গে দেখা হবে জানিনা, অন্তত আজকের দিনটা কারো চোখে জল দেখতে চাই না রে। মৃনাল বেশি দূরে ছিল না তাই এইসব কথোপকথন গুলোর কিছুটা তার কানে এলো। সে কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে রে রিমি? রিমি মৃণালের কন্ঠ শুনে আচমকা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বললো, ও তেমন কিছু না, পরে বলবো। নির্মলা চাইছিলো না এই কথাটা নিয়ে আলোচনা শুরু হোক তাই সে রিমি আর মৃণালের কথার মধ্যেই বলে উঠলো চল এবার চিড়িয়াখানা টা দেখি। এবার মৃণাল সেই কথা থেকে বেড়িয়ে এসে নির্মলার কথার উত্তরে বললো হ্যাঁ যাবো তার আগে চল সুড়ঙ্গ টার ব্যাপারে একটু জেনে নি। সবাই একসঙ্গে সুড়ঙ্গ টার সামনে এসে দাঁড়ালো।
মৃনাল আবার আগের ভঙ্গিতেই বলতে শুরু করলো, এই সুড়ঙ্গ টি ইংরেজদের চোখে ধুলো দিয়ে লুকিয়ে ব্যাবসা করার জন্য বানানো হয়েছিলো। এই সুড়ঙ্গ টি সরাসরি চলে যায় এখান থেকে প্রায় চার কিমি দূরে জগৎ শেঠের বাড়ি। এই সূত্রে বলে রাখা ভালো জগৎ শেঠের পুরোনো এবং বড়ো বাড়িটি কিন্তু গঙ্গা নদীর তলায় তলিয়ে গেছে। আর তাই এই সুড়ঙ্গ টি সবসময় জলমগ্ন থাকে। এমনকি গঙ্গা নদীর জল বাড়লে এই সুড়ঙ্গের জলস্তর ও বারে আর কমলে কমে। এই কথা শুনে সুমন্ত আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইলো তাহলে এখন যেই জগৎ শেঠের বাড়িটি সবাই দেখতে যায় সেটা কি নকল? মৃণাল জবাব দিলো না সেটাও জগৎ শেঠেরই বাড়ি, কিন্তু যে বাড়িটা নদীর গর্ভে তলিয়ে গেছে তার তুলনায় এটি খুবই ছোট।
মৃণাল বললো সন্ধ্যা হবার আগেই সবাই কে বাড়ি পৌঁছাতে হবে চল এবার চিড়িয়াখানা টা দেখেই বেড়িয়ে পড়বো।
চিড়িয়াখানায় প্রবেশ করতে করতে মৃণাল বললো এর আগে আমি যখন এসেছিলাম তখন চিড়িয়াখানা টাও ঐ অতিথিশালার মতো ভগ্নাবশেষ হয়ে পড়েছিলো ইদানীং এটিকে ঠিক করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তাই এই ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো না। যা অনুভব করার তা নিজে চোখে দেখেই কর। তবে হ্যাঁ এটুকু জানি যে যখন চিড়িয়াখানাটা ঠিক ছিল তখন এখানে বাঘ, সিংহ বা কোনো মাংষাষী পশু রাখা হতো না। কারন রাখলে তাদের মাংস খেতে দিতে হবে, আর জৈন রা তাদের বাড়ির চৌকাঠে পর্যন্ত মাংসের স্পর্শ পড়তে দেশ না।
তবে এখন কি কি আছে সেটা ভেতরে গিয়েই বুঝতে পারবো। ভিতরে গিয়ে তারা দেখলো কি সুন্দর সুন্দর পাখি। যেসব পাখির তারা চোখে দেখা তো দূরের কথা নামও শোনেনি। বিভিন্ন দেশের পাখি আছে সেখানে, এমনকি উট পাখিও চোখে পড়লো। এছাড়াও খরগোস, বিভিন্ন মাছ, হাঁস বিভিন্ন প্রাণী ছিলো।
সেখান থেকে বেড়িয়ে সবাই ঠিক সময়ে বাড়ি পৌঁছে গেলো। রাত্রি তখন সবে ৯ টা বেজেছে, ঠিক এমন সময় মৃণালের ফোন বেজে উঠলো। বিপরীত দিকে রিমির আওয়াজ। রিমি কাঁদতে কাঁদতে বলনো মৃনাল আমাকে ক্ষমা করে দিস, তোকে আমি মিথ্যা বলেছি। মৃণাল কিছু বুঝতে না পেরে বললো এই পাগলি কি হয়েছে কাঁদছিস কেন? রিমি একটা ছোট্ট শ্বাস নিয়ে বললো নির্মলা সব জানে রে। মৃণালের মাথায় যেন পাহাড় ভেঙ্গে পড়লো। মৃণাল এবার একটু বুঝতে পারলো বললো মানে, কি বলছিস তুই? রিমি আবার কাঁদতে কাঁদতে বললো হ্যাঁ রে সব জানে নির্মলা। এমন কি তুই ফোনে যা বলিস সেইসবও জানে। তোর মনে আছে আমরা একদিন মতিঝিল থেকে এসে রাতে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলাম আর সেদিন নির্মলা আমাকে ফোনে পাইনি, ব্যস্ত বলেছিল। সেদিনই ও বুঝে গেছিলো। পরে আমাকে পরিবারের সদস্যের দিব্যি দিয়ে সব জানতে চায়, তাই অগত্যা আমাকে সব সত্যি বলতে হয়। এমনকি তার পরেও যা যা বলতিস সব তাকে বলতে হতো। কিন্তু তোকে কিছু বলতে পারতাম না কারন আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলো। আজ তা ভেঙ্গে দিয়েছি। আজ কাঠগোলা বাগানের সামনে পুকুর পাড়ে টিফিন করার সময় যখন তুই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলি কি ব্যাপার তখন এই ব্যাপারেই কথা হচ্ছিল। মৃনাল নির্বাক। কি বলবে বা কি করবে ভেবে পাচ্ছিলো না। তার মধ্যেই রিমি বলতে থাকলো, ওকে আটকা মৃণাল, কাল ই ওর ভাগলপুর চলে যাবার কথা, যেতে দিস না ওকে। আমি জানি ওই ও তোকে খুব ভালোবাসে । তোকে ছাড়া ওই ও ভালো থাকবে না আমি জানি। মৃণাল তখন আর কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলো না। তার মাথার মধ্যে তখন হাজারো চিন্তা ভির করেছে। রিমি মৃণালের অবস্থা বুঝতে পারছিলো। কিন্তু সেই মুহূর্তে কারো কিছু করার ছিলো না।
{নবম পর্ব (শেষ পর্ব ) প্রকাশ করা হবে ১৪ই জুন অর্থাৎ আগামী রবিবার}
বিমান চন্দ্র দাস
অষ্টম পর্ব
শুভ জন্মদিনের বার্তার সঙ্গে ঘুম ভাঙ্গলো নির্মলার। সেদিন সবাই সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়েছিলো লালবাগের উদ্দেশ্যে। প্রায় ১০ টা নাগাদ হাজির হলো কাঠগোলা বাগান বাড়ির সামনে, ততক্ষণে কাকলি আর সুমন্ত সেখানে এসে অপেক্ষা করছিল। সবাই এক জায়গায় হতেই একটা খুশির আমেজ।
রাস্তার পাশেই একটি সিংহদ্বার তার সামনে অনেক মানুষের সমাগম।
সেই দ্বারের ভেতরে প্রবেশ করতেই দুই ধারে অগনিত গাছ আর তার মধ্যেই কিছু ঐতিহাসিক স্তম্ভ আর কিছু অশ্বারোহী মূর্তি। মধ্যের সরু রাস্তা ধরে কয়েক পা এগোতেই দেখা গেল টিকিট কাউন্টার। সেখানে টিকিট কেটে এবার আসল জায়গায় প্রবেশ করলো তারা। কাকলি বললো একটা গাইড নিলে ভালো হতো। মৃণাল তার উত্তরে বললো গাইডের দরকার হবে না, চল আমি সব বুঝিয়ে বলছি। সুমন্ত মজার ছলে বলে উঠলো হ্যাঁ চল আজ আমাদের বাংলার শিক্ষক মহাশয় ইতিহাস পড়াবেন। হাসি-ঠাট্টা করতে করতেই এগোচ্ছে তারা। মুখ্য বাড়িটি পৌঁছাবার আগেই বাম দিকে গুপ্ত সুড়ঙ্গ আর ডান দিকে চিড়িয়াখানা। মৃণাল বললো এগুলো পড়ে দেখবো আগে প্রধান যে বাড়িটা সেটা দেখে নি। সেই কথামতো এগিয়ে গেল তারা। এবার কাঠগোলা বাগান বাড়ির সামনে উপস্থিত হলো। কি সুন্দর দৃশ্য,
মুখ্য বাড়িটি থেকে বেড়িয়ে পূর্ব দিকে এগিয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে আঙ্গুলের ইশারায় দেখালো মৃণাল, ঐ যে ওখানে সামান্য উঁচু স্টেজের মতো আছে দেখছিস, ওটাকে জলসাঘর বা নাচমহল বলে। চল দেখে আসি। নাচমহলটির উপরে উঠে মৃনাল তার বক্তব্য চালু রাখলো, এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা নাচের আসর বসতো। ততকালীন নবাবী লোকেরা, ইংরেজ সাহেবরা ও ধনী ব্যাবসায়ী রা এখানে আসতো মনোরঞ্জনের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু নর্তকী কে নিয়ে আসা হতো এখানে। তখনকার ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় তাদের মধ্যে একজন ছিলো হীরা বাঈ। সে নাকি প্রতি সন্ধ্যায় নাচ করার জন্য ৫০০০ মুদ্রা নিতো। তার একটি বিশাল ছবি হাজারদুয়ারী তে টাঙ্গানো আছে। সেখান থেকে তারা দুই ধারে গোলাপের বাগান ছাড়িয়ে এগিয়ে চললো সামনের দিকে। একটু এগোতেই একটা ছোট স্তম্ভ লাগোয়া দুই ধারে দুটো মাছের মূর্তি দেখা গেল।
মৃণাল :- আমি এই জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, দেখতে চাইছিলাম প্রথম প্রথম আমার মনে যে প্রশ্ন আসতো সেটা তোরাও ভাবিস কিনা। এই বলে পুরো ইতিহাস বলতে শুরু করলো মৃণাল, এটি নবাবদের তৈরী নয়। রাজস্থান থেকে আগত এক ব্যাবসায়ী এটি নির্মাণ করান। তিনি ছিলেন জৈন ধর্মাবলম্বী, তাই এই মন্দিরটিও জৈন মন্দির। মন্দিরটি আদিনাথ মন্দির বা পরেশনাথ মন্দির নামে পরিচিত। আদিনাথ হলো জৈন ধর্মের প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভনাথের আরেক নাম। মন্দির টি প্রথম থেকে এখানে ছিলো না ১৮৭৩ সালে তৎকালীন বাড়িটির মালিক তার মায়ের ইচ্ছা তে এটি বানান। আর এই বাগানবাড়ি টি তৈরী করান বর্তমান জিয়াগঞ্জ শ্রীপত সিং কলেজের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীপত সিং দুগরের পূর্বপুরুষ লক্ষীপত দুগর। তারা চার ভাই ছিলেন - লক্ষীপত সিং দুগর, ধনপত সিং দুগর, মহীপত সিং দুগর ও জগপত সিং দুগর। তারা এখানে ব্যাবসার সূত্রে এসেছিলেন, এখানে এসে তখনকার সব থেকে ধনী ব্যাবসায়ী জগৎ শেঠের সঙ্গে তাদের ভালো সম্পর্ক হয়। সেই সুবাদেই তৎকালীন নবাবের কাছে মাত্র ১২০০ টাকায় ২৫০ বিঘা জমি কিনে নেন। তার পরই তৈরী করান এই বাগান বাড়ি টি। সিংহদ্বার দিয়ে প্রবেশের পরে পরেই যে চারজনের অশ্বারোহী মূর্তি দেখেছিলি সেগুলো এদের ই চার ভাইয়ের। বর্তমানে লক্ষীপত সিং দুগরের দশম প্রজন্ম সঞ্জয় সিং দুগর ও সিদ্ধার্থ সিং দুগর এই প্রাসাদটির দেখাশোনা করেন। তারা বর্তমানে কলকাতায় থাকেন। আসার সময় মুখ্য বাড়িটির পিছনে যে ভগ্নাবশেষ টি দেখলি সেটা অতীতে অতিথিশালা ছিলো। এর পর তারা বাড়িটির সামনে যে পুকুর টা আছে তার বিপরীত পাড়ে এলো, সেখান থেকে বাড়িটির অসাধারণ দৃশ্য চোখে পড়লো। আহা! কি দৃশ্য মন জুড়িয়ে গেলো সবার। মৃনাল বললো চল ঐ গাছের তলায় বসে টিফিন টা বের করে খেয়ে নি তার পর সুড়ঙ্গ আর চিড়িয়াখানা টা দেখবো। খাওয়ার পর পাঁচ মিনিট পুকুর পাড়েই বসলো তারা। কেউ ছবি তুলতে ব্যস্ত, কেউ পাইচারী করতে শুরু করলো। সেই সময় রিমি নির্মলাকে ডেকে বললো, নির্মলা আমি আর মিথ্যা বলতে পারছি না, আর কতদিন লুকিয়ে রাখবো? কিছু মনে করিস না আমি তোর প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গলাম আজই ওকে সব বলে দিবো। নির্মলা রিমির মুখে হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, এরকম করিস না বন্ধু। যা বলার এখান থেকে ফেরার পর বলিস। কালই আমি ভাগলপুর চলে যাবো আবার কবে তোদের সঙ্গে দেখা হবে জানিনা, অন্তত আজকের দিনটা কারো চোখে জল দেখতে চাই না রে। মৃনাল বেশি দূরে ছিল না তাই এইসব কথোপকথন গুলোর কিছুটা তার কানে এলো। সে কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে রে রিমি? রিমি মৃণালের কন্ঠ শুনে আচমকা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বললো, ও তেমন কিছু না, পরে বলবো। নির্মলা চাইছিলো না এই কথাটা নিয়ে আলোচনা শুরু হোক তাই সে রিমি আর মৃণালের কথার মধ্যেই বলে উঠলো চল এবার চিড়িয়াখানা টা দেখি। এবার মৃণাল সেই কথা থেকে বেড়িয়ে এসে নির্মলার কথার উত্তরে বললো হ্যাঁ যাবো তার আগে চল সুড়ঙ্গ টার ব্যাপারে একটু জেনে নি। সবাই একসঙ্গে সুড়ঙ্গ টার সামনে এসে দাঁড়ালো।
মৃনাল আবার আগের ভঙ্গিতেই বলতে শুরু করলো, এই সুড়ঙ্গ টি ইংরেজদের চোখে ধুলো দিয়ে লুকিয়ে ব্যাবসা করার জন্য বানানো হয়েছিলো। এই সুড়ঙ্গ টি সরাসরি চলে যায় এখান থেকে প্রায় চার কিমি দূরে জগৎ শেঠের বাড়ি। এই সূত্রে বলে রাখা ভালো জগৎ শেঠের পুরোনো এবং বড়ো বাড়িটি কিন্তু গঙ্গা নদীর তলায় তলিয়ে গেছে। আর তাই এই সুড়ঙ্গ টি সবসময় জলমগ্ন থাকে। এমনকি গঙ্গা নদীর জল বাড়লে এই সুড়ঙ্গের জলস্তর ও বারে আর কমলে কমে। এই কথা শুনে সুমন্ত আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইলো তাহলে এখন যেই জগৎ শেঠের বাড়িটি সবাই দেখতে যায় সেটা কি নকল? মৃণাল জবাব দিলো না সেটাও জগৎ শেঠেরই বাড়ি, কিন্তু যে বাড়িটা নদীর গর্ভে তলিয়ে গেছে তার তুলনায় এটি খুবই ছোট।
মৃণাল বললো সন্ধ্যা হবার আগেই সবাই কে বাড়ি পৌঁছাতে হবে চল এবার চিড়িয়াখানা টা দেখেই বেড়িয়ে পড়বো।
চিড়িয়াখানায় প্রবেশ করতে করতে মৃণাল বললো এর আগে আমি যখন এসেছিলাম তখন চিড়িয়াখানা টাও ঐ অতিথিশালার মতো ভগ্নাবশেষ হয়ে পড়েছিলো ইদানীং এটিকে ঠিক করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তাই এই ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো না। যা অনুভব করার তা নিজে চোখে দেখেই কর। তবে হ্যাঁ এটুকু জানি যে যখন চিড়িয়াখানাটা ঠিক ছিল তখন এখানে বাঘ, সিংহ বা কোনো মাংষাষী পশু রাখা হতো না। কারন রাখলে তাদের মাংস খেতে দিতে হবে, আর জৈন রা তাদের বাড়ির চৌকাঠে পর্যন্ত মাংসের স্পর্শ পড়তে দেশ না।
তবে এখন কি কি আছে সেটা ভেতরে গিয়েই বুঝতে পারবো। ভিতরে গিয়ে তারা দেখলো কি সুন্দর সুন্দর পাখি। যেসব পাখির তারা চোখে দেখা তো দূরের কথা নামও শোনেনি। বিভিন্ন দেশের পাখি আছে সেখানে, এমনকি উট পাখিও চোখে পড়লো। এছাড়াও খরগোস, বিভিন্ন মাছ, হাঁস বিভিন্ন প্রাণী ছিলো।
সেখান থেকে বেড়িয়ে সবাই ঠিক সময়ে বাড়ি পৌঁছে গেলো। রাত্রি তখন সবে ৯ টা বেজেছে, ঠিক এমন সময় মৃণালের ফোন বেজে উঠলো। বিপরীত দিকে রিমির আওয়াজ। রিমি কাঁদতে কাঁদতে বলনো মৃনাল আমাকে ক্ষমা করে দিস, তোকে আমি মিথ্যা বলেছি। মৃণাল কিছু বুঝতে না পেরে বললো এই পাগলি কি হয়েছে কাঁদছিস কেন? রিমি একটা ছোট্ট শ্বাস নিয়ে বললো নির্মলা সব জানে রে। মৃণালের মাথায় যেন পাহাড় ভেঙ্গে পড়লো। মৃণাল এবার একটু বুঝতে পারলো বললো মানে, কি বলছিস তুই? রিমি আবার কাঁদতে কাঁদতে বললো হ্যাঁ রে সব জানে নির্মলা। এমন কি তুই ফোনে যা বলিস সেইসবও জানে। তোর মনে আছে আমরা একদিন মতিঝিল থেকে এসে রাতে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলাম আর সেদিন নির্মলা আমাকে ফোনে পাইনি, ব্যস্ত বলেছিল। সেদিনই ও বুঝে গেছিলো। পরে আমাকে পরিবারের সদস্যের দিব্যি দিয়ে সব জানতে চায়, তাই অগত্যা আমাকে সব সত্যি বলতে হয়। এমনকি তার পরেও যা যা বলতিস সব তাকে বলতে হতো। কিন্তু তোকে কিছু বলতে পারতাম না কারন আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলো। আজ তা ভেঙ্গে দিয়েছি। আজ কাঠগোলা বাগানের সামনে পুকুর পাড়ে টিফিন করার সময় যখন তুই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলি কি ব্যাপার তখন এই ব্যাপারেই কথা হচ্ছিল। মৃনাল নির্বাক। কি বলবে বা কি করবে ভেবে পাচ্ছিলো না। তার মধ্যেই রিমি বলতে থাকলো, ওকে আটকা মৃণাল, কাল ই ওর ভাগলপুর চলে যাবার কথা, যেতে দিস না ওকে। আমি জানি ওই ও তোকে খুব ভালোবাসে । তোকে ছাড়া ওই ও ভালো থাকবে না আমি জানি। মৃণাল তখন আর কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলো না। তার মাথার মধ্যে তখন হাজারো চিন্তা ভির করেছে। রিমি মৃণালের অবস্থা বুঝতে পারছিলো। কিন্তু সেই মুহূর্তে কারো কিছু করার ছিলো না।
{নবম পর্ব (শেষ পর্ব ) প্রকাশ করা হবে ১৪ই জুন অর্থাৎ আগামী রবিবার}
👌👌👌
ReplyDelete